বাংলাদেশ ক্রিকেটের সহোদর

বাংলাদেশেও ক্রিকেট পরিবারের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তবে, আজকে ক্রিকেটের পরিবার নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘ভাই’  বা সহোদরদের নিয়ে একটু আড্ডা দেই চলুন। একই পরিবার থেকে এসে জাতীয় দলে অবশ্য দুই ভাই বাংলাদেশে খেলেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলাদের সংখ্যা অনেক।

‘পরিবারতন্ত্র’ খুবই পরিচিত একটা টার্ম। এই শব্দের ব্যবহার ক্রিকেটেও আছে বিস্তর। এক পরিবারের একাধিক সদস্য, কিংবা দুই ভাই এক সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও খেলেছেন।

বাংলাদেশেও ক্রিকেট পরিবারের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তবে, আজকে ক্রিকেটের পরিবার নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘ভাই’  বা সহোদরদের নিয়ে একটু আড্ডা দেই চলুন। একই পরিবার থেকে এসে জাতীয় দলে অবশ্য দুই ভাই বাংলাদেশে খেলেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলাদের সংখ্যা অনেক।

  • মিশা-মুনির: দুই ওপেনার

৫০-এর দশকে এখনকার বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল, তখন প্রথম এখানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালু হয়। তখন অধিকাংশ ক্রিকেটারই ছিলেন উর্দুভাষী। পূর্ব পাকিস্তান দলেও ছিল উর্দুভাষীদের দাপট। সেই সময় যে গুটিকয়েক বাঙালি পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলতেন, তাঁদের একজন হলেন ফখরুজ্জামান। একই সাথে ফুটবলও খেলতেন তিনি।

তাঁর  দুই ছেলে আসাদুজ্জামান মিশা ও তারিকুজ্জামান মুনির। মুনির বাংলাদেশের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান। যদিও, সেই ম্যাচটা প্রথম শ্রেণির স্বীকৃতি পায়নি। মিশা ও মুনির দু’জনই আশির দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন।

ডান হাতি মিশা ছিলেন সলিড ওপেনিং ব্যাটসম্যান। আশির দশকে আবাহনীতে নাজিম সিরাজির সাথে ওপেন করতেন। ১৯৮৩ সালে নাজিম চলে যান আমেরিকায়। তখন তাঁর ভাই মুনিরের সাথে ওপেন করতেন। ১৯৮৪ থেকে চার বছর জাতীয় দলে খেলেন মিশা।

১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে জাতীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে আলোচনায় আসেন মুনির। সেই ম্যাচে আতহার আলী খানও ১৫৫ রান করেন।

ট্রিপল সেঞ্চুরির এক সপ্তাহ পরেই জাতীয় দলে ডাক পান মুনির। দুলীপ মেন্ডিসের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের বিপক্ষে তাঁর ৩৯ রানের একটা ইনিংসও আছে। তবে, সেই ম্যাচ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নয়। প্রয়াত মুনির পরে ম্যাচ রেফারির দায়িত্বও পালন করেন।

  • রাজিনদের চার ভাই

রাজিন সালেহ অভিষেক টেস্টের স্কোয়াডে ছিলেন। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দারুণ ক্যাচও ধরেছিলেন সেই ম্যাচে। পরে সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ছিলেন। বিশেষ করে, টেস্ট ক্রিকেটের জন্য তাঁর ব্যাট ছিল দারুণ মানানসই।

রাজিনদের পরিবার সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনের খুবই পরিচিত মুখ। রাজিনরা চার ভাই-ই ক্রিকেট খেলেছেন। রাজিন ছাড়া বাকি তিনজন হলেন নাসিরুল আলম, রেজাউল হক ও সায়েম আলম। চারজন সিলেট বিভাগের হয়ে খেলতেন। ঢাকা লিগও খেলেছেন চার জন। রাজিন সালেহ ছাড়া কেউই অবশ্য জাতীয় দলে আসতে পারেননি।

  • বিখ্যাত দুই ভাই: তামিম-নাফিস

বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম ক্রিকেটীয় পরিবার হলো চট্টগ্রামের খান পরিবার। এই পরিবার থেকে প্রথম বাংলাদেশ দলে খেলেছেন আকরাম খান। আকরাম খান বাংলাদেশের ক্রিকেট ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করে দেয়া আইসিসি ট্রফি জয়ের নায়ক। আকরাম খানদের ভাইরাও লিগ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছেন।

আকরাম খানের পর আরও দুই জন এসেছেন এই পরিবার থেকে যারা কিনা বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলেছেন। একজন হলেন নাফিস ইকবাল খান আর একজন হলেন তামিম ইকবাল খান। এর মধ্যে নাফিস ইকবাল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে ভূমিকা রেখেছেন। আর তামিম ইকবাল বর্তমানে বাংলাদেশে ওয়ানডে অধিনায়ক।

তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ওপেনার। নাফিস ইকবালও ছিলেন ওপেনার। তবে, তাঁর ক্যারিয়ার খুব লম্বা হয়নি। নাফিস ইকবাল জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন ১১ টেস্ট এবং ১৬ ওয়ানডে। এখানে রান করেছিলেন যথাক্রমে ৫১৮ এবং ৩০৯।

  • চাটগাইয়া ভাই: মিনহাজুল আবেদীন এবং নুরুল আবেদীন

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বিশ্বকাপের ম্যাচ জয়ের ম্যাচ সেরা খেলোয়াড় ছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের ওয়ানডে ফরম্যাটের একজন নিয়মিত মুখ ছিলেন। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করা ছাড়াও ডান-হাতি অফ স্পিনটা বেশ ভালভাবেই করতে জানতেন নান্নু। ২৭টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে তিনি করেছিলেন ৪৫৩ রান। সেই সাথে তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ১৩টি উইকেট।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের মতোই তাঁর ভাই নুরুল আবেদীন নোবেল ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। মাত্র চারটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন নোবেল। ব্যাট হাতে খুব একটা সফলতার দেখা পাননি তিনি।

তাই হয়ত তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা হয়নি। লিস্ট এ ক্যারিয়ারটাও ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। মাত্র ছয় ম্যাচের ক্যারিয়ার ছিল নুরুল আবেদীন নোবেলের। ভাই যখন দেশের মানুষদের ভরসার প্রতীক তখন নোবেল রয়ে যান পর্দার আড়ালে।

  • নাফিস-নাইম: বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা

নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন না হলে হয়ত শাহরিয়ার নাফিস হতে পারতেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ওপেনিং ব্যাটারদের একজন। স্বল্প সময় তাঁর ব্যাটিং প্রদর্শনে ভক্তদের মনে প্রত্যাশার বীজ বুনে দিয়েছিলেন শাহরিয়ার নাফিস। তবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

নিজেকে আর মেলে ধরার সুযোগটা পাওয়া হয়নি তাঁর। তবুও ঘরের ভক্তদের কাছে আলাদা খ্যাতি রয়েছে ৭৫টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ও ২৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলা এই বাঁ-হাতি ব্যাটারের। ২০১৩ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা শাহরিয়ার নাফিস এখন কর্মরত আছেন বাংলাদশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি)।

শাহরিয়ার নাফিসের ছোটভাই ইফতেখার নাইমও নিজের ক্যারিয়ারটা হয়ত গড়তে চেয়েছিলেন ক্রিকেটে। তবে তাঁর দৌড় থেমে যায় ঘরোয়া ক্রিকেটে। মাত্র ২৮টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন ইফতেখার। এর পর নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা আর দীর্ঘ করতে পারেননি তিনি। রয়ে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে, ইদানিং আমেরিকায় ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টায় আছেন তিনি।

মজার ব্যাপার হল, নাফিস ও নাঈমের কাজিন হলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম সেরা নির্বাচক ফারুক আহমেদ। এছাড়াও বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

  • টাইগার জাহাঙ্গীরের ভাই সোহেল খান

জাতীয় দলের হয়ে তিনটি ওয়ানডে খেলেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটার জাহাঙ্গীর আলম। ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত ছিলেন টাইগার জাহাঙ্গীর নামে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ স্কোয়াডেও ছিলেন। তবে, শেষ মুহূর্তে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুকে জায়গা দিতে বাদ পড়েন তিনি।

তাঁর ভাই সোহেল খান পাপ্পু অবশ্য তেমন পরিচিত কেউ ছিলেন না। ছয়টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ও ১০ টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেন ডান-হাতি এই বোলার।

  • তালুকদার ব্রাদার্স

রনি তালুকদার বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ। জাতীয় দলের হয়ে একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৫ সালে। এরপর আট বছর বিরতি দিয়ে ২০২৩ সালে ফিরে খেলেছেন ১০ টি-টোয়েন্টি ও একটি ওয়ানডে। নিয়মিত পারফর্ম করেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।

রনির তুলনায় জনি তালুকদার তুলনামূলক অপরিচিতই বলা যায়। তবে, ডান-হাতি এই ব্যাটসম্যানও নিয়মিত খেলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।

  • নাসু-মঞ্জুর

ময়মনসিংহের নাসির আহমেদ নাসু আশির দশকের মধ্যভাবে দেশের সেরা উইকেটরক্ষক ছিলেন। ১৯৯৪ সাল অবধি, মানে খালেদ মাসুদ পাইলট আসার আগ পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলে। পরে বিসিবির ডাটা অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন লম্বা সময়।

তাঁর বড় ভাই প্রয়ান মঞ্জুর আহমেদও ছিলেন উইকেটরক্ষক। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যানের টপ অর্ডারে ব্যাট করার সক্ষমতা ছিল। ৮০-৮১’র মৌসুমে ময়মনসিংহে এমসিসির বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে তিনি দারুণ ব্যাট করেছিলেন। যদিও, পরে আর ক্রিকেটে নিয়মিত হননি।

  • বাবু-সামি

১৯৭৭ সালের এমসিসির বিপক্ষে ম্যাচে ইউসুফ রেজাউর রহমান বাবু তৃতীয় সিমার হিসেবে বোলিং করার সাথে সাথে আট নম্বরে ব্যাটিংও করেন। জাতীয় দলেও খেলেন। তবে, তখন বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।

১৯৮২ সালের আইসিসি ট্রফিতে তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে ১১৫ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। তরুণ নাজিম সিরাজির সাথে ১৭২ রানের জুটি গড়েন, যেখানে সিরাজি করেন ৫২ রান। যদিও, শেষ অবধি ম্যাচটায় বাংলাদেশ দল তিন উইকেটে হারে।

বাবুর ছোট ভাই সামিউর রহমান সামি ছিলেন ডান-হাতি মিডিয়াম পেসার। ১৯৭৯ সালের আইসিসি ট্রফির দলে সুযোগ না পেলেও খেলেন ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পরের দুই আসরে। বাংলাদেশের হয়ে দু’টি ওয়ানডেও খেলেন তিনি।

  • দ্য শাহ ব্রাদার্স

বাংলাদেশের সেরা পেসার কে? – এই প্রশ্নের জবাবে অনেকে এখনও জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহর নাম নিয়ে থাকেন। যদিও, তিনি পাঁচটার বেশি ওয়ানডে খেলতে পারেননি বাংলাদেশের হয়ে। তবে, আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের নিয়মিত পারফর্মার ছিলেন। ১৯৭৯ সালের আইসিসি ট্রফিতে কানাডার বিপক্ষে ১২ ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়ে নিয়েছিলেন চার উইকেট।

বাদশাহদের চার ভাই ক্রিকেটার ছিলেন। বাকিরা হলেন, নাদির শাহ, মুন্না শাহ ও আজিম শাহ। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান নাদির শাহ খেলোয়াড় হিসেবে যতটা না , তাঁর চেয়ে বেশি খ্যাতিমান ছিলেন আম্পায়ার হিসেবে। মুন্না শাহ ও আজিম শাহও ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন। মুন্না খেলেছেন জাতীয় দলেও।

তাদের মামাতে ভাই হলেন নাজিম সিরাজি। ঢাকার ক্রিকেটে খেলতেন আবাহনীর হয়ে। ১৯৮২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ভারতীয় দল ডেকান ব্লুজের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে করেন ৫৬ রান। আইসিসি ট্রফিতে পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে করেন হাফ সেঞ্চুরি। যদিও, খেলোয়াড়ী জীবন বেশ আগাম শেষ করে দিয়ে তিনি পাড়ি জমান আমেরিকায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...