দ্য ‘ব্রুনো’ ইউনাইটেড

টাইটানিকের জ্যাকের কথা মনে আছে?

নাহ, ভুল প্রশ্ন করে ফেললাম মনে হয়। জ্যাককে কার মনে নেই? লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর জ্যাক ছিলেন গল্পের নায়ক, গল্পের প্রাণ। আমি বলছি জ্যাকের টাইটানিকে উঠবার ঘটনা। বাজিতে জিতে সামান্যর জন্য টাইটানিকে উঠতে পারা, ব্রুনো ফার্নান্দেস আর ইউনাইটেডের কাহিনীও ঠিক একইরকম।

শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর একদম শেষদিকে এসে ব্রুনো ফার্নান্দেসকে দলে ভেড়ায় ইউনাইটেড। বেশ বড় একটা অঙ্কও অবশ্য খরচ করতে হয়েছে তাদের। এক দফায় ৪৭ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হলেও সব শর্ত পূরণ করতে পারলে তা গিয়ে দাঁড়াবে মোট ৬৭ মিলিয়নে। সবমিলিয়ে ব্রুনো ছিলেন ইউনাইটেডের ইতিহাসের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ট্রান্সফার। এরকম দাম দিয়ে খেলোয়ায়ড় কেনার গল্প নতুন নয় ইউনাইটেডের জন্য। তবে এর আগেও কেউই সে অনুযায়ী ফল দিতে পারেননি। কিন্তু ব্রুনো যেন ছিলেন একদম উৎকৃষ্ট উদাহরণ, একজন বিগ মানি সাইনিং কেমন হতে হয়।

ব্রুনোর সাইনিং নিয়ে মিডিয়ায় তেমন কথা ছিলই না বলতে গেলে। সাধারণত ইউনাইটেড কোনো খেলোয়াড়ের দিকে হাত বাড়ালে আগে থেকেই মিডিয়া উৎসুক হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রুনো একেবারেই যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন ইউনাইটেডে। কথাবার্তা ছাড়াই দুইদিনের নোটিশে ব্রুনো যোগ দেন ইউনাইটেডে।

ঠিক একবছর আগে ২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রথম ‘রেড ডেভিল’ জার্সি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয় ব্রুনোর। ওলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডার্সের বিপক্ষে গোলশূণ্য ড্রয়ের ম্যাচ দিয়েই শুরু তার। এরপর থেকে মোট ৫২ ম্যাচে দেখা গিয়েছে তাকে লাল জার্সিতে। এই এক বছরে ঠিক কতটা বদলেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড? তাঁর উদাহরণ পয়েন্ট টেবিলের দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া সম্ভব।

প্রথম যখন ইউনাইটেডে আসেন ব্রুনো, তখন তারা চ্যাম্পিয়নস লিগ দূরে থাক, ইউরোপাতে খেলার কোনো অবস্থানেই নেই। ৭ম স্থানে থেকে শুরু করা ফেব্রুয়ারি থেকে সিজনের শেষ পর্যন্ত ইউনাইটেড খেলেছে একই ইন্টেন্সিটিতে। গত মৌসুমে ব্রুনো যোগ দেওয়ার পর থেকে হারতেই ভুলে গিয়েছিল ইউনাইটেড। এই মৌসুমেও দেখুন না, হাতে গুনে চার ম্যাচে হেরেছে ইউনাইটেড। এমনকি সকলকে টেক্কা দিয়ে প্রিমিয়ার লিগের রেইসেও রয়েছে ভালোভাবে। ইউনাইটেডের পয়েন্ট টেবিল থেকে সরে ব্রুনোর ইন্ডিভিজ্যুয়াল পারফরম্যান্সের দিকে তাকালে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য।

গত এক বছরে তাঁর (৫৩) থেকে বেশি ম্যাচ খেলেছেন একমাত্র অধিনায়ক হ্যারি ম্যাগুইয়ার (৫৪)। ৩৬৬ দিনে শুধু ডি-বক্স, ডি-বক্সের বাইরে প্রতিপক্ষ দলকে নিয়ে একপ্রকার খেলা করেছেন ব্রুনো। ইউনাইটেডের জার্সিতে করেছেন ২৮ গোল আর ১৭ এসিস্ট। চান্স ক্রিয়েশনেও কম যাননি, ১৩৬টি চান্স ক্রিয়েট করেছেন ইউনাইটেডের মাঝমাঠে তিনি একাই।

প্রিমিয়ার লিগ তো আরো নস্যি। যোগ দেওয়ার পর থেকে ৩৫ ম্যাচে তার অবদান ৩৩ গোল। ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডে ডেব্যু সিজনে এরকম ঈর্শনীয় ফিগার ছোঁয়ার সামর্থ্য হয়েছিল একমাত্র অ্যান্ডি কোলের। প্রথম এক বছরে কোল সবমিলিয়ে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন ৪১ গোলে।

অ্যান্ডি কোল খেলেছেন সেই মিড-নাইন্টিজে; এখনকার কথাই ধরা যাক। গত ৩৬৬ দিনের হিসাবে তার ধারেকাছেঘেষার মতন অবস্থান কারো নেই। তাঁর নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে শুধু হ্যারি কেইন, ২৯ গোল ও এসিস্ট নিয়ে তিনি দ্বিতীয়।

তবে ইন্ডিভিজ্যুয়ালি তাকে টেক্কা দিতে পেরেছেন দুজন। বলতে গেলে প্রিমিয়ার লিগের পড় খাওয়া দুই তারকা, মোহাম্মদ সালাহ আর কেভিন ডি ব্রুইনা। দুজনেই গোল আর এসিস্টের হিসেবে আছেন ব্রুনো থেকে সামান্য এগিয়ে। ব্যবধান মাত্র এক। ডি ব্রুইনার ১৫ এসিস্টের বদলে ব্রুনোর ১৪, আর সালাহর ২০ গোলের বিপরীতে ব্রুনোর ১৯।

গোল এসিস্ট করে দলের চিত্র বদলে দিয়েছেন, তা তো আগেই বলেছি। কিন্তু এখানেও সামান্যর জন্য সেরা অবস্থানটা হাতছাড়া। ব্রুনো দলে আসার পর থেকে একটি দলই মাত্র তাদের থেকে বেশি পয়েন্ট লাভ করেছে, সেটি হলো ম্যানচেস্টার সিটি (৭৪)। আর্সেনালের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা জিতলে হয়তো সেখানেও টেক্কা দিতে পারতো।

ব্রুনো মূলত ইউনাইটেডের প্লেমেকিংয়ের নতুন রূপ। একসময় যেখানে ইউনাইটেডে প্লেমেকার গিজগিজ করতো, সেখানে গত কয়েক বছর ধরে যেই আসছিল না কেন, ঠিক ক্লিক করতে পারছিলেন না। ডি মারিয়া, মাতা, মাতিচ কিংবা স্বয়ং পগবাও ঠিকমতো এই রোলে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এক পগবাকে আনলক করার কথা বলে তো হাসির পাত্রই হয়ে গিয়েছিলেন ‘স্পেশাল ওয়ান’খ্যাত জোসে মোরিনহো। তবে সেই পগবা তালার চাবি যেন খুলেছেন ব্রুনোই।

গত একবছরে শর্ত চান্স ক্রিয়েশনে দ্বিতীয় (২১২) আর ফাইনাল থার্ডে দেওয়া পাসের সংখ্যায় প্রথম (২১)। ইউনাইটেডের স্ট্রাইক ফোর্সকে বল দেওয়া নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তার সমাধান তো করেইছেন, তার সাথে সাথে নিজেও হাত লাগিয়েছেন গোল স্কোরিংয়ে। ফলাফল ব্রুনো হয়ে উঠেছেন ইউনাইটেডের সর্বেসর্বা।

তার ফলাফলও পেয়েছেন হাতে নাতে। ১২ মাস হয়েছে প্রিমিয়ার লিগে ভিড়েছেন, এরমধ্যে প্রায় ৩ মাস খেলা বন্ধ ছিল কোরোনা পরিস্থিতি সামলাতে। বাকি ৮ মাসের (জানুয়ারির সেরা খেলোয়াড় অ্যাওয়ার্ড এখনও দেওয়া হয়নি) মধ্যে ৪ মাসেই হয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়। এক বছরে ৪বার ‘প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ’ পাওয়ার রেকর্ড প্রিমিয়ার লিগে কেউই গড়তে পারেনি। শুধু প্রিমিয়ার লিগ না, ইউনাইটেডেও ‘স্যার ম্যাট ব্যাসবি প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মাত্র ২২ ম্যাচ খেলে।

ইউনাইটেডে এর আগেও এমন একজন পর্তুগিজ ভিড়েছিলেন, খুবই কম বয়সে স্পোর্টিং সিপি থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে আনা হয়েছিল তাকে। তাঁর কাজ ছিল শুধু প্রতিপক্ষ ডিফেন্স চূর্ণ করা। নাম নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না।

ব্রুনো ফার্নান্দেস ইউনাইটেডের জন্য সেরকমই নতুন আশার আলো। ৯০ মিনিটের মাথায় দলকে সমতায় এনে যিনি তাগাদা দেন আরেক গোল করার। দলের প্রয়োজনে নার্ভ শক্ত রেখে একের পর এক পেনাল্টি নিয়ে যাচ্ছেন, রাইভালদের কাছ থেকে ‘পেনাল্টি মার্চেন্ট’ শুনতেও তাঁর বিন্দুমাত্র গায়ে লাগেনি। এই ব্রুনো নতুন ইউনাইটেডের সূতিকাগার। যে ইউনাইটেড আবার জয়ের ধারায় ফিরেছে, আবার টপ অফ দ্যা টেবিল হয়ে প্রিমিয়ার লিগের স্বপ্ন দেখছে। এই ইউনাইটেড সত্যিই ব্রুনোময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link