১.
উইলোপ্রেমিকদের অবচেতন মনে তখন একমাবেদ্বিতীয়ম রাজা হিসাবে রাজত্ব পরিচালনা করছেন এক ক্যারিবিয়ান সম্রাট। সময়টা ১৯৭৯। ইংল্যান্ডে সিরিজ খেলতে গিয়ে ভারতীয় দল এক প্রস্তুতি ম্যাচে নেমেছিল সমারসেটের বিরুদ্ধে। সামারসেটের হয়ে খেলতে নামছেন সেই ক্যারিবিয়ান।
ব্যাট হাতে নামার শুরুতে তখন সবে রোপটা ক্রস করেছেন, তখনই সম্মুখ সমরে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছানো এক গোঁফওলা ভারতীয় এসে তাঁকে বলে গেলো – ‘Welcome my Bunny!’ বাংলা করলে দাঁড়ায় – ‘ওহে আমার প্রিয় খাদ্য, তোমায় স্বাগতম।’ সেদিন কোনো উত্তর ছিলনা ক্যারিবিয়ান সম্রাটের কাছে।
সেবার প্রথম নয়, ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই দুই ইনিংসে যথাক্রমে চার আর তিন রানে ক্যারিবিয়ান সম্রাটকে তুলে নিয়েছিল সেই গোঁফওলা কন্নড়। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও সেই ভারতীয় শেষ টোকাটা দিয়ে গেলো ক্যারিবিয়ানকে। তখন ম্যাচের মাঝামাঝি সময়। ব্যাট হাতে উইলো সম্রাটের স্টাম্পটা তখনও অধরা।
অধিনায়ক গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ বোলিংয়ে আনলেন ক্যারিবিয়ান উইলো সম্রাটের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় খাদককে। ঠিক সেইমুহুর্তে পিছনে ফিরে উইকেটরক্ষক সুরিন্দরখান্নাকে ব্যাটসম্যানটি বলেছিল – ‘What has he been brought on for?’ বলা বাহুল্য বরাবরের মতো সেবারেও ক্যারিবিয়ানকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখালেন সায়াহ্ন-অবতীর্ণ ভারতীয়টি।
সেই উইলোসম্রাটের নাম ছিল ভিভিয়ান রিচার্ডস। আর রিচার্ডস খাদ্য বানানো বোলারের নাম জানতে হলে আপনাকে চলে যেতে হবে ৭৩’এর ইডেনে। ট্রানজিস্টরের পর ট্রানজিস্টারে তখন ছেয়ে গেছে ইডেন গার্ডেন্স। জোরে জোরে বাজছে মুকেশজির গান। কারণ একটাই, মাত্র একশো বিরানব্বইয়ের টার্গেটে আস্তে আস্তে পৌঁছে যাওয়া টনি গ্রেগের ইংল্যান্ডকে থামাতে এখন যে বোলারটি আসছেন, মুকেশজির গানে তিনি শোণিত খুঁজে পান।
আর চলতি বাংলা কথায় ‘চাগানো’র শিক্ষা পেতে হলে ইডেনের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে কোনো স্টেডিয়ামকে। ইডেনে তখন মুকেশজির গানের সম্ভাষণ। আর উজ্জীবিত বোলারের বলে সঙ্গেই আউট টনি গ্রেগ।ইডেন জুড়ে একটাই চিৎকার – ‘Chandra… chandra… chandra…’।
লেগস্পিন শিল্পের ভিঞ্চি কিংবা পোলিওমায়েলাইটিসে রূক্ষ ডানহাতকে মারণাস্ত্রে পরিণত করা ঈশ্বর -পরিচয়টা দুভাবেই দেওয়া যায়। হ্যাঁ ঈশ্বরই। তাসখন্দের কমিউনিস্ট পার্টির মতোই ভারতবর্ষে ঈশ্বর দ্বিজ-অর্থাৎ দুবার জন্ম যার। একবার শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের এমআরএফ উইলোর মাধ্যমে, আরেকবার তার প্রায় ত্রিশ বছর আগে পোলিও আক্রান্ত এক শিশুর লয়েড, সোবার্স থেকে ভিভ রিচার্ডস কিংবা টনি গ্রেগ থেকে ইলিংসওয়ার্থকে ‘খাদ্য’ বানানোর মধ্য দিয়ে। নামটাই তো বলা হয়নি। ইডেনের সেই চন্দ্রসুরের অবিসংবাদিত চন্দ্রযান – বিএস চন্দ্রশেখর। ভেঙে বললে আসে ভগবত সুব্রামানিয়া চন্দ্রশেখর।
২.
১৯৭১ এর ওভাল। মুখোমুখি ভারত-ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড বলতে মনে পড়ে ইলিংসওয়ার্থের সেই দুর্ভেদ্য ইংল্যান্ড। টানা ২৬ টেস্টে অপরাজেয় ইংল্যান্ড। স্যুইং আর শৈত্যের শহর ইংল্যান্ড। সেবার পাঁচ বছর পর প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল চন্দ্রশেখরের। পাঁচ বছর আগে একটা মোটর বাইক সটান চলে গিয়েছিল তাঁর উপর দিয়ে।
অবশ্য পোলিওকে যিনি হারাতে পেরেছেন, তাঁর কাছে এ আর এমনকি। রীতিমতো পাঁচ বছর পরে প্রত্যাবর্তন ঘটে তাঁর। সেবার ৭১’এর সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ডে গেছে দল। দলে তরুণ সংযোজন সুনীল গাভাস্কার। তৃতীয় টেস্টে তখন ব্যাট করছেন জন এডরিক। বেশ সেঁটে গেছেন উইকেটে।
চন্দ্রশেখর ভাবছেন পরের বলে গুগলি দেবেন, এমন সময় সতীর্থ দিলীপ সরদেশাই তাঁকে বলেন, ‘এক মিল-রেফ ডাল (Give a mil-ref)।’ মিল-রেফ হলো আমেরিকান রেস দৌড়ের মাঠের এক দ্রুততম ঘোড়া। চন্দ্রশেখরের বোলিং অ্যাকশন, রান-আপ ছিল এক মিডিয়াম পেস বোলারের মতোই।
মাঝেমধ্যেই তিনি এক স্পেশাল বল করতেন, যার মধ্যে স্পিন থাকত না, বেস বাউন্স থাকত, আর এতোটাই জোরে তার নামটা দেওয়া হয়েছিল রেসকোর্সের দ্রুততম মিল-রেফের নামানুসারে। সরদেশাইয়ের কথামতো এডরিককে অনেকটা রান আপ নিয়ে ‘Mil-ref’ দিলেন। সাথে সাথেই আউট এডরিক। সেই ম্যাচের পর এডরিকের আউট প্রসঙ্গে তৎকালীন ইংরেজ অধিনায়ক ইলিংসওয়ার্থ একবার বলেছিলেন, ‘His bat was still in the air when the stumps broke off।’
ভাবতে পারছেন বলের গতি কতটা বেশি ছিল। সেই ইনিংসের চমক আরো বাকী ছিল। চন্দ্রশেখরের ঐতিহাসিক ৩৮/৬ বোলিং ফিগার। টানা ছাব্বিশ ম্যাচে অপরাজেয় ইলিংসওয়ার্থের ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ভারত পেয়েছিল প্রথমবার বিদেশে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ। ইতিহাস হয়ে আজও রয়ে গেছে একাত্তরের ওভাল টেস্ট।
ভারতের সর্বকালের সেরা স্পিনার কে? প্রশ্নটা শুনলেই একে একে চলে আসবে অনেক নাম। হয়তো প্রথম সারিতে থাকবে অনিল কুম্বলে কিংবা বিষেণ সিং বেদি। কিন্তু ভিভ রিচার্ডস থেকে সোবার্স কিংবা লয়েড থেকে টনি গ্রেগ যে দুটি নামকে ভারতীয় স্পিনিংয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছেন সে দুটি নাম আজও অনেকেরই অজানা – সুভাষ গুপ্তে এবং বিএস চন্দ্রশেখর।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এক শিশু পোলিওমায়েলাইটিসে আক্রান্ত হবার ফলে ডানহাতটা একেবারে সরু-বিকৃত হয়ে যায়,আর সেই ছেলেটাই তাঁর ডান হাতটাকে পরবর্তীকালে করে তুলেছিল মারণাস্ত্র। একবার একজন তাঁর ডানহাতের বর্ণণা দেবার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘It seems there was no muscle, only a bone covered by a skin।’
আর সেই বিকৃত ডানহাত থেকেই বের হতো লয়েড-সোবার্স-রিচার্ডস বধের একমাত্র লেথাল লেগস্পিন গুলো। এমন উদাহরণ ইতিহাসে খুব কমই আছে। যুদ্ধে ডানহাত নষ্ট হবার পর বামহাত দিয়ে শ্যুটিংয়ে বিশ্বজয় করা ক্যারোলির মতোই, চন্দ্রশেখরের জীবনীটাও কম রোমাঞ্চকর নয়। সে জীবনে কোনোগীতিকাব্য ছিলনা, অথচ প্রত্যেকটা লাইনেই রাবিন্দ্রিক, ‘ঝড়কে আমি করব মিতে’-এর আশ্বাস।
৩.
আরেকটা ঘটনার কথা বলি। একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুনই না কুম্বলে-ভাজ্জির নামে চাপা পড়ে যাওয়া এই স্পিনারের শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনীগুলো। ১৯৭৬-এর নিউজিল্যান্ড। কিউই পাখির দেশ নিউজিল্যান্ড। মার্টিন ক্রোয়ের দেশ নিউজিল্যান্ড। ইডেন পার্কে তখন বসেছে ভারত-নিউজিল্যান্ড টেস্টের আসর। প্রসঙ্গত বলে রাখি সেই টেস্ট বিখ্যাত ছিল দুটি কারণে – এক এরাপল্লি প্রসন্নের ৭৬/৮ বোলিং ফিগার, যেটা এখনও অবধি বিদেশে পারফর্ম করা যে কোনো ভারতীয়র বেস্ট বোলিং ফিগার।
আরেকটা কারণ সেই ম্যাচে বাবা লালা অমরনাথের মতোই ছেলে মানে সুরিন্দর অমরনাথের অভিষেকেই সেঞ্চুরির রেকর্ড। কিন্তু এ দুটি কারণ ছাড়াও, একটা তৃতীয় কারণ ছিল,সেটা সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতে নিউজিল্যান্ড বলতে আমাদের চোখের সামনে যুধিষ্ঠীরের কালিমাহীন সদান্যায়বাদী এক মূর্তির অনুরণন গড়ে ওঠে। সত্যিই তাই। কিন্তু সেই ম্যাচে কিছুটা হলেও সেটা বিঘ্নিত ছিল দুই আম্পায়ারের কারণে-ডেনিস কপস আর রবার্ট মন্টেথ।
তারা বারংবার নিউজিল্যান্ডকে হোম অ্যাডভান্টেজ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই পরিমাণ এতোটাই তীব্র ছিল যে পরিস্কার এলবিডব্লুও দেওয়া হচ্ছিল না। গাভাস্কার সেই ম্যাচ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘Bat-pad catches were smilingly turned down and leg befores we appealed were stupid।’ ভাবতে পারছেন কতটা তীব্র।
এমন সময় এক কাণ্ড করে বসেন এক সদাশান্ত এক খেলোয়াড়। জীবনে প্রথমবারের মতো মেজাজ হারালো সে। কিউই ব্যাটসম্যান কেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্টাম্প ছিটকে দিল। নিশ্চিত আউট। কিন্তু আম্পায়ের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ এতটাই তীব্র ছিল, সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সেই বোল্ডের অ্যাপিল করতে থাকে আম্পায়ের কাছে।
আম্পায়ার বলে, ‘Yes he is bowled!’ উত্তরে সেই বোলার বলেছিল. ‘I know he is bowled, but is he out?’ হিউমার+স্যাটায়ার+ফান+ইনটেলেক্ট মিশ্রিত একটা প্রতিবাদি লাইন। কিছুটা সাধারণ, কিছুটা অসাধারণ। বোলারের নাম চন্দ্রশেখর।
সৌরভ গাঙ্গুলি তাঁর সর্বকালের সেরা ভারতীয় টেস্ট একাদশে স্পিন বোলিংয়ে রেখেছিলেন দুজনকে -অনিল কুম্বলে আর বিষেণ সিং বেদী। প্রথমে আসি কুম্বলের কথায়। অনিল কুম্বলে তখন অতিরিক্ত স্পিড এবং কম ফ্লাইটের জন্য সমালোচনার মুখে পড়ছিলেন। সে সময় তাকে গ্রুম করেছিলেন এই চন্দ্রশেখরই। তিনি বলেছিলেন, ‘Coaches will tell you to speed down and flight more because they Don’t understand you. Ignore them all.’
এবার পালা বিষেণ সিং বেদীর।একবার ইন্টারভিউতে চন্দ্রশেখরকে নিয়ে বলতে বললে, তিনি একটাই কথা বলেছিলেন, ‘I saw GOD in his right hand।‘ পোলিওমায়েলিটিসকে পায়ে মাড়িয়ে যিনি দুর্ভেদ্য উইন্ডিজকে খাদ্য বানাতে পারেন কিংবা অপরাজেয় ইংল্যান্ডকে ঘূর্ণির জালে বিদ্ধ করতে পারেন,তাঁর হাতে হয়তো সত্যিই ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বর এক ও অভিন্ন নয়। সিন্ধুনদের দেশে ঈশ্বর জন্মেছেন বারংবার। ভিন্নবার।