অভিজ্ঞতার মরণ নেই

মা-খালাদের মুখে একটা প্রবাদ প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়। পু্রোনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে। আক্ষরিক অর্থে পুরোনো চালে ভাত বেশি হয় এমন কিছুই হয়ত বোঝাতে চান তারা। সত্য মেনেই নেই, মা-খালারা যেহেতু বলেন। কিন্তু ফুটবল মাঠে কি এমনটা ঘটতে দেখা যায়? না মানে চাল থেকে ভাত নয়, নিস্তেজ অভিজ্ঞতা সতেজ হওয়া। যায় এই মৌসুমেই তো তেমন এক উদাহরণ হোসে মরিনহো।

আরও এক উদাহরণ কিন্তু রয়েছে। সেটা কার্লো আনচেলত্তি, রিয়াল মাদ্রিদের কোচ। একেবারেই আলোর থেকে খানিক দূরেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘড়ির কাটার চলাচলে এখন তিনিই যেন আলোর উৎস। তিনি এখন একমাত্র। হ্যা, এই যে সেদিন রিয়াল মাদ্রিদকে জেতালেন তাদের ইতিহাসের ১৪ তম শিরোপা। রিয়ালের সাথে দ্বিতীয়তে থাকা রোমার শিরোপার দূরত্ব দুই গুণ।

সেদিক থেকে তিনি একমাত্র নন, অনন্য রিয়াল মাদ্রিদ। তবে কার্লো আনচেলত্তি অনন্য আবার খানিক ভিন্ন দিকে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চারটি শিরোপা জেতা একমাত্র কোচ এখন এই ইতালিয়ান ভদ্রলোক। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুইবার এবং ইতালিয়ান পরাশক্তি এসি মিলানের হয়ে জিতেছেন দু’টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। তবে এই তো গেল মৌসুমের ইউরোপের ফুটবল পাড়ায় একটা রব উঠে গেল আনচেলত্তি ঠিক আর পেরে উঠছেন না।

ফুটবলের আধুনিকায়নের সাথে সাথে আনচেলত্তি যেন বেশ পুরোনো। তাকে দিয়ে আর যাই হোক শিরোপা জেতা সম্ভব নয়। তার নেতৃত্বে ইংলিশ ক্লাব এভারটন খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না ইউরোপিয় ফুটবল অঙ্গনে। তাই হয়ত মানুষের এমন অভিমত। এত নিন্দা। তবে নিন্দা আর সমালোচনার মাঝেও রিয়াল মাদ্রিদ ভরসা রাখে ইতালিয়ান এই মাস্টারমাইন্ডের উপর।

আর যখন আনচেলত্তি ফিরলেন চিরচেনা সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তখন তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে বলেছিলেন যে অস্ত্র জমা দিয়েছেন ট্রেনিং নয়। আর তার মধ্যে থাকা রসদ যে একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি সে প্রমাণটাই তো তিনি রাখলেন। তিনি প্রমাণ করলেন রিয়াল মাদ্রিদ এবং তিনি শিরোপা জিততে জানেন। তারা হয়ত খানিক পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন তবে ডিএনএ থেকে শিরোপা জয় আলাদা হয়নি কখনোই।

স্রেফ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। রিয়াল আর আনচেলত্তির জোট হল। আর বাকিটা তো সবারই জানা। এক মৌসুম বিরতির পর আবারও লা লিগার শিরোপা গেল রিয়ালের ঘরে। তাও আবার দ্বিতীয় স্থানে থাকা বার্সেলোনার সাথে ১৩ পয়েন্টের ব্যবধান রেখে। কার্লো এসেই হয়ত তার ছেলেদের একটা বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন যে হতে হবে ধারাবাহিক। রিয়ালের খেলোয়াড়রা সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন পুরো লিগ জুড়েই।

অন্যদিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শুরুতে একটা হোঁচট খেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ, ঘরের মাঠে পুচকে শেরিফ টিরাসপোলের কাছে হেরে গিয়ে। ওই হার যেন ছিল শাপেবর। সে হোঁচট খেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সব টোটকা যেন ইঞ্জেকশন দিয়ে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে পৌঁছে দেন আনচেলত্তি। ব্যাস, এরপর তো রীতিমত রুপকথার যাত্রা। কি এক সঞ্জীবনী সুধা খাইয়ে মাঠে নামিয়েছিলেন আনচেলত্তি, কে জানে!

রিয়াল মাদ্রিদ যেন বনে যায় অদম্য, দুর্দমনীয়, দুর্বার। কাওকেই যেন পরোয়া করে না। প্যারিস সেইন্ট জার্মেই, ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি ও লিভারপুলের মত দলকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। সেখানটায় কৃতীত্ব তো আনচেলত্তিরও খানিক কম নয়। তিনি তার শুরুর একাদশের উপর ভরসা রেখে তাদেরকে সময় দিয়েছেন। তাদেরকেই লম্বা সময় একসাথে খেলার সুযোগ দিয়ে রসায়ন শক্ত করার সুযোগ দিয়েছেন।

আবার সে কার্লো আনচেলত্তি ম্যাচের পরিস্থিতি আর নিজের খেলোয়াড়দের সক্ষমতা একেবারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন মুহূর্তের মধ্যেই। আর রদ্রিগো গোয়েজ এবং এডুয়ার্ডো কামাভিঙ্গাদের মত তরুণ খেলোয়াড়দের নামিয়ে দিয়েছেন বুকভরা আত্মবিশ্বাস দিয়ে। টগবগে রক্তের এক একটি পাগলা ঘোড়া। এদেরকে রুখবে কে? শুধু কখন ব্যবহার করতে হবে সেটা জানাই যেন ছিল মুখ্য। আর আনচেলত্তি তার প্রতিটা খেলোয়াড়ের নাড়িনক্ষত্রই হয়ত জানতেন।

কি অসাধারণ সব প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী করে দিয়ে গেলেন আমাদেরকে এই কার্লো আনচেলত্তি! তার এই দল যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলবে তাও তো কেউ ভাবেনি। ইংলিশ মিডিয়া তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদকে বারংবার। তবে ফুরিয়ে যাওয়া মিছিল থেকে বেড়িয়ে আসা ৬২ বছর বয়সী এক শান্ত, নিশ্চুপ লোক তার ছোকড়াদের মাঠের খেলায় দিলেন সব জবাব। আর চুপিসারে বলে গেলেন অভিজ্ঞতার মরণ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link