২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। জার্মানদের বিপক্ষে নেইমারহীন ব্রাজিলিয়ান সেলেসাওরা এক প্রকার উঁড়ে যায়। ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে উঁড়িয়ে ফাইনালে পা দেয় জার্মানি। ঘরের মাঠে মারাকানায় এমন লজ্জাজনক পরাজয়ের পর সমালোচনার ঝড় তোলেন সাবেক ব্রাজিলিয়ান তারকারা।
কেউ যেন এমন বিভৎস পরাজয় কল্পনাও করতে পারেনি। এরপরই ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব থেকে বাদ পড়েন ফিলিপ স্কোলারি। আর নতুন দায়িত্ব পান সাবেক বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক কার্লোস দুঙ্গা।
এটি অবশ্য দুঙ্গার দ্বিতীয় বারের মতো ব্রাজিলের দায়িত্ব পাওয়া। এর আগে ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব পান দুঙ্গা। ২০০৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর বাদ পড়েন তৎকালীন কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা।
এরপর কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেই দায়িত্ব পান দুঙ্গা। খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতার কারণেই মূলত তাকে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর অধীনে ব্রাজিল বেশ দুর্দান্ত পারফর্ম করছিলো। প্রথম পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই জয় পায় দুঙ্গার দল।
১৬ আগস্ট, ২০০৬। নরওয়ের বিপক্ষে কোচ হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করেন দুঙ্গা। পরের বছর ২০০৭ সালে দুঙ্গার অধীনে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে প্রথম কোপা জয় পায় সেলেসাওরা। পরের বছরই অবশ্য আর্জেন্টিনা এই হারের প্রতিশোধ নেয়।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-০ তে হেরে ব্রোঞ্জ জয় করে ব্রাজিল। এরপর ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয় পায় ব্রাজিল। দুঙ্গার অধীনে আরো এক সাফল্য পাওয়ার পর সেলেসাওদের লক্ষ্য থাকে ২০১০ বিশ্বকাপ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপের শেষ ষোলতে চিলিকে হারানোর পর কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল! এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর দুঙ্গা ব্রাজিলের কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপরই নতুন দায়িত্ব পান লুই ফেলিপে স্কলারি!
দুঙ্গাকে ব্রাজিলিয়ানরাই কোচ হিসেবে অপছন্দ করতেন। তার বড় কারণ ছিলো দুঙ্গার জেদ আর নেতিবাচক কৌশল। তাঁর অধীনে রোনালদিনিহো, কাকারাও নিজের জায়গা দলে পাঁকা কিনা সেটা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। ২০০৬ সালে ব্রাজিলের দায়িত্ব পাবার পর বেশ কিছু খেলোয়াড় তিনি খুঁজেও বের করেছিলেন। কিন্তু তাঁর একরোখা স্বভাবের কারণে মিডিয়া সহ খেলোয়াড়দের সাথেও মনমালিন্য হয়।
২০১০ বিশ্বকাপেও দুঙ্গার একরোখা সিদ্ধান্তে কারণে ব্রাজিলের হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখা যায়। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলকে সবাই ‘দুঙ্গার দূর্গ’ নাম দেয়। দলের খেলার স্টাইল পরিবর্তন করতে গিয়ে দলের পারফরম্যান্স নামিয়ে আনেন একদম মাটিতে।
ব্রাজিলের কৌশল ও খেলার ধরণে পরিবর্তন আনেন বিস্তর। যার কারণে সমর্থকদের চক্ষুশ্যূল হন। সাবেকরাও ছিলেন সমালোচনামুখর।
দুঙ্গার উপর সাবেক ব্রাজিলিয়ান তারকা সহ ব্রাজিল সমর্থকদের ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ ছিলো খেলার ধরন পরিবর্তন আনা। ব্রাজিল সবসময়ই তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখে পাসিং ফুটবল খেলে আসতো। যেখানে ছিলো শৈল্পিক ছোঁয়া। শৈল্পিক ফুটবল থাকলেও, টানা পাঁচ বিশ্বকাপ শিরোপা বঞ্চিত হয় ব্রাজিল। জিকো, সক্রেটিসদের আলোচিত দলটাও ব্যর্থ হয়।
তখনই খেলার ধরণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে ব্রাজিল। তাঁর চূড়ান্ত পরিবর্তনটা আসে দুঙ্গাদের হাত ধরে। প্রথমে খেলোয়াড়-অধিনায়ক হিসেবে, পরে কোচ হিসেবে। লাতিন ফুটবলে তখন যোগ হয় ইউরোপিয়ান ফলাফল নির্ভর ফুটবল। ব্রাজিলের তখন যেকোনো মূল্যে ট্রফি দরকার। দুঙ্গারা তাই সাফল্যের পথেই হাঁটলেন। সৌন্দর্য্য সেখানে গৌণ। সফলও হলেন, একই সাথে হলেন সমালোচিত।
জেদি ছিলেন দুঙ্গা। সমালোচনায় তিনি কখনোই কর্ণপাত করেননি। বরং বরাবরই দাবি করেছেন, তিনি ব্রাজিলকে সেরা স্থানে নিতেই এসেছেন।
৩১ অক্টোবর ১৯৬৩। ব্রাজিলে জন্মগ্রহণ করেন কার্লোস দুঙ্গা। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা দেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। ১৯৮৩ সালে ফিফা অনূর্দ্ধ-২০ বিশ্বকাপ দিয়েই তার যাত্রা শুরু। সেই টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এবং আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে হারিয়ে শিরোপা জয় করে ব্রাজিল। তার এক বছর পরই ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে সিলভার জয় করে সেলেসাওরা। এরপরই ব্রাজিল জাতীয় দলে পদচারণা শুরু হয় দুঙ্গার।
১৯৮৭ সালে ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলা শুরু করেন তিনি। এর দু’বছর পরই ১৯৮৯ সালে ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে উরুগুয়েকে হারিয়ে প্রথম কোপার শিরোপা জয় পায় দুঙ্গা। ১৯৯০ বিশ্বকাপে একজন তরুন প্রতিভাবান হিসেবেই খেলেছিলেন দুঙ্গা। তবে ৯০ এর বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডেই আর্জেন্টিনার কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। যেখানে বেশ বাজে পারফরম্যান্স শো করে সেলেসাওরা।
দুঙ্গা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে বেশ দারুণ ফুটবল খেলা উপহার দিতে লাগলেন। তাকে সেই সময় ‘এরা দুঙ্গা’ নামে ডাকা হয়। তাঁর খেলার স্টাইলের কারণেই মূলত তাকে এই নামে ডাকা হতো। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আর ছন্দের কারণে ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপেও জায়গা করে নেন দুঙ্গা। আর সেখানেই তাঁর অধীনে ফাইনালে ইতালিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে জয় পায় ব্রাজিল।
যদিও, সেই বিশ্বকাপটা অধিনায়ক হিসেবে শুরু করেননি দুঙ্গা। শুরুতে অধিনায়ক ছিলেন রাই। কিন্তু, পারফরম্যান্সজনিত সমস্যায় রাই জায়গা হারান। তখন নেতৃত্বের দায়িত্ব পান দুঙ্গা। বাকিটা ইতিহাস। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ হাতে নেন কোনো ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক।
মিডফিল্ডে দুঙ্গাদের অসাধারণ নৈপুণ্যে ম্যাচে ভীত গড়তেই পারেনি ইতালি। শিরোপা জয়ের পর আরো চার বছর দলে ছিলেন দুঙ্গা। এর বেশিরভাগ সময়টাই ছিলেন অধিনায়ক হিসেবেই। ১৯৯৮ সালে অবসরের আগে ব্রাজিলের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৬ গোল করেন দুঙ্গা।
এরপর ২০০৬ সালে কোচ হিসেবে প্রথম পদাপর্ণ! ২০১০ সালে সেই পদ থেকে সরেও গেলেন। কিন্তু নিয়তি তাকে আবারো ফেরায় একই পথে।
২০১৪ বিশ্বকাপে ফেলিপ স্কোলারির অধীনে জার্মানির বিপক্ষে ভরাডুবির পর পুনরায় কোচের দায়িত্বে দুঙ্গা। টানা দশ ম্যাচে জয় নিয়ে ভালোই শুরু করেন দুঙ্গা। এই দশ ম্যাচে ব্রাজিল গোল খায় মাত্র দু’টি! নেইমারও ছিলেন সেরা ফর্মে। এরপর অলিম্পিকের জন্য দল গঠন করেন দুঙ্গা।
সেখান থেকে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে উঠিয়েও এনেছিলেন তিনি। এরপরই আসে ২০১৬ কোপা আমেরিকা! যেখানে গ্রুপ পর্বেই পেরুর কাছে ১-০ গোলে হেরে বাদ পড়ে সেলেসাওরা। ২৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে লজ্জার দাগ টেনে দেন দুঙ্গা! ব্যাস, এরপরই দুঙ্গার বিদায় ঘন্টা বেজে যায়।
দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে ব্রাজিলের প্রয়োজন ছিলো পেরুর বিপক্ষে শুধু ড্র! কিন্তু পারেননি তাঁরা। ১৯৮৫ সালের পর পেরুর বিপক্ষে সেটি ছিলো প্রথম পরাজয়। আর ১৯৮৭ সালের পর প্রথমবার কোপার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় সেলেসাওরা।
এরপর ২০১৬ সালের ১৪ জুন ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব থেকে দুঙ্গাকে বরখাস্ত করা হয়। যদিও তিনি আশায় ছিলেন এই দায়িত্বে তিনি আরেকটি সুযোগ পাবেন। তবে সেই আশায় তাঁর গুড়েঁবালি। কোচ হিসেবে সফল হননি এমনটাও নয়। দুঙ্গার অধীনে ৮৬ ম্যাচের মধ্যে ৬০ ম্যাচে জয় পায় সেলেসাওরা। ৮ ম্যাচে ড্র আর হারের মুখ দেখেছিলো মাত্র ৯ ম্যাচে।
প্রথম মেয়াদে খেলার স্টাইল পরিবর্তন করে সমালোচনার মুখে পড়েন। খেলোয়াড়দের সাথে বিতর্ক সহ ২০১০ বিশ্বকাপে ভরাডুবি। আর দ্বিতীয় মেয়াদে কোপায় ব্যর্থতাই দুঙ্গার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। একরোখা স্বভাবের না হলে হয়তো সম্মান নিয়েই সেলেসাওদের মনে বেঁচে থাকতেন চিরকাল।