এক রাজার রাজপাট

ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী কাউন্টি দল ল‍্যাঙ্কাশায়ার। হোম গ্রাউন্ডের পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা পুলিশে অভিযোগ দায়ের করলেন। কি অভিযোগ? তাঁর ও তাঁর পাশের বাড়ির কাঁচ নাকি একজনের বড় বড় ছক্কার আঘাতে বারবার ভেঙে পড়ছে, তাই তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ দায়ের করেছেন।

অভিযোগে অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না। কারণ ল‍্যাঙ্কাশায়ারের এক বরেণ্য তার ভারী ব‍্যাট দিয়ে বলকে সজোরে আঘাত করতেন যা ওইসব কাণ্ড ঘটাত। শুধু ব‍্যাটেই নন, তিনি তার অধিনায়কত্বেও অতিশয় আক্রমণাত্মক। বিপক্ষকে চেপে ধরতে তার আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব বডিলাইন সিরিজের অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের সাথে তুলনা করা হতো।

মাঠে যতটা এই ক্যারিবিয়ান আক্রমণাত্মক, মাঠের বাইরে ততটাই তিনি নিস্পৃহ। কথাবার্তা, হাবে-ভাবে, চালচলনে তিনি এক অন‍্য জগতের মানুষ।‌ আবার ডগলাস জার্ডিনের মত নেতিবাচক চরিত্র নন।

ছোটবেলা হতেই ক্রিকেটের প্রতি অনাবিল একটি টান অনুভব করতেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন‍্যান‍্যদের মতোই শরীর ছিল টানটান ও লম্বা চাওড়া। অসাধারণ টেকনিকের সাথে জোরে শট করতে পারতেন। সঙ্গে ছিল শরীরচর্চা ও স্প্রিন্টিং।

মানুষটার ব্যাপারে এখন হয়তো একটু একটু আঁচ করা যাচ্ছে। জ্বি, তিনি হলেন ক্লাইভ লয়েড, অবিসংবাদিত সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের একজন।

ক্লাইভ লয়েড কিশোর বয়সে পা দেওয়ার পরই পৃথিবীটা দ্রুত বদলে যায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি একটি মারপিট ঠেকাতে গিয়ে নিজের চোখে আঘাত পান এবং তখন থেকেই চশমা পড়তে বাধ্য হন! অন‍্যদিকে ১৫ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। সাংসারিক চাকুরিতে যোগ দেন, ক্রিকেটে সময় দেওয়া কমে যেতে থাকলেও চেষ্টা করতে থাকেন।

যে ক্লাবের হয়ে খেলতেন সেই ক্লাবের দলনায়ক ফ্রেড উইলিস তার উপর অগাধ আস্থা রাখতেন। অধিনায়ক নানা ভাবে লয়েডকে সাহায্য করে গিয়েছেন সারাজীবন। যাকে নিয়ে তিনি বলেছেন এক সময় ‘মানুষটির হৃদয় প্রাসাদের থেকেও বড়।’

প্রথম শ্রেণীর ক‍্যারিয়ারের শুরটা খারাপ হলেও নিজেকে আস্তে আস্তে তৈরী করে নিতে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বীপ-রাজনীতির শিকার হয়ে জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। যা নিয়ে সেই সময়ের অধিনায়ক স্যার গ্যারি সোবার্স সমালোচনা করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের।

কিন্তু প্রতিভাকে আটকে রাখা যায় না। ভারত সফরে তিনি নির্বাচিত হলেন এবং দ্বিতীয় টেস্টেই ভগবৎ চন্দশেখর, ভেঙ্কট রাঘবন , সেলিম দুরানিদের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে ৭৮ রানে অপরাজিত থেকে দলকে অসাধারণ জয় এনে দিলেন। এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে সেঞ্চুরি তার ভিত শক্ত করে তুললো।

মাঝে কিছুটা অফফর্ম এলো। এরপর আবার হঠাৎ মেরুদণ্ডে চোট পেয়ে ক্রিকেট থেকে সাময়িক বিরতি নিতে হলো। ক‍্যারিয়ার টালমাটাল অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ক্রিকেট খেলতে গেলেন। এদিকে গ‍্যারি সোবার্সের চোট; অধিনায়ক কে হবেন তা নিয়ে টানাপোড়েন!

হাল ধরলেন গায়ানার প্রধানমন্ত্রী ফোর্বস বার্নহাম, যিনি ক্লাইভ লয়েডের একজন গুণমুগ্ধ। বিশেষ ভাবে তাকে উড়িয়ে আনা হলো, কিন্তু অধিনায়ক করা না হলেও দলে স্থান পেলেন। তাকে বোর্ড আশ্বস্ত করলো এই বলে যে তিনিই তাঁদের ভবিষ্যত। তবে আরেক কিংবদন্তি রোহান কানহাই ক‍্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে, তাই তাকে সম্মান জানানোর জন্য অধিনায়ক করা হয়েছে।।

কিন্তু, তিনি থেমে থাকলেন না। আগে কন্টাক্ট লেন্স ব‍্যাবহার করলেও, আবার পুরানো চশমা চোখে তুললেন। অস্ট্রেলিয়ার সাথেই ১৭৮ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংস খেললেন। এরপর আবার ইংল্যান্ডে গিয়ে সেঞ্চুরি। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারত সফরে এলো তিনি দলনায়ক হলেন।

এরপর শুধু সামনে এগিয়ে চলা। যখন নতুন পথিক তথা সীমিত ওভারের বিশ্বকাপ শুরু হলো তার অধিনায়কত্বেই প্রথম দুটি সংস্করনের শিরোপা মাথায় তুললেন। কিন্তু যতটা আমরা ছবিতে দেখেছি তাতেও নিস্পৃহ, অর্থাৎ এটা তো তাদের দলেরই অর্থাৎ তারই প্রাপ্য।

দুটি বিশ্বকাপ জয় ও তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে হারবার পর আর ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাননি। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে তার ক‍্যারিয়ার শেষ করেন। অধিনায়ক হিসেবে টানা তিন ফাইনাল খেলা, দুটির শিরোপা জয় – আজকের দিনে বসে অধিনায়কত্বের এই পরিসংখ্যান কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে।

কেমন ছিল ক্লাইভ লয়েডের ব‍্যাটিং? তার সমসাময়িকদের সবার বক্তব্য প্রায় এক। বিশাল স্ট্রাইড, প্রচণ্ড শক্তি, সহজাত টাইমিং এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব তাঁকে করেছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ও কার্যকর কন্ট্রোল্‌ড হিটার!

তিনি যখন বোলাদের উপর চড়াও হতেন-দর্শক হিসেবে এর চেয়ে মধুর দৃশ্য খুব কমই ছিল। তাঁর খুনে, শ্বাসরুদ্ধকর এবং সহজাত ব্যাটিংয়ের মধ্যে এক ধরনের আদিম সৌন্দর্য্য ছিল। বিশেষ করে আশির দশকে, যখন তিনি সেরা ফর্মে ছিলেন।

অন‍্যদিকে ফিল্ডার হিসেবেও তিনি অদম্য। ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি কাভার পজিশনের দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলেন। বিশাল এবং অ্যাথলেটিক হবার কারণে তাঁকে এড়িয়ে বল মারা খুবই কঠিন ছিল। পরবর্তীতে মেরুদন্ডে ব্যথা পাবার পর সাধারণত প্রথম স্লিপেই ফিল্ডিং করতেন। সেখানেও দারুণ সফল ছিলেন।

সব মিলিয়ে তিনি এমন একটি বিশাল ভিত্তি ছিলেন, যাঁকে ঘিরেই অসামান্য প্রতিভাধর একদল ক্রিকেটার এক হয়েছিল এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে পথ চলা শুরু করেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সব সময়ই সেরা হবার মত সকল যোগ্যতাই ছিল, তিনি যে সর্বপ্রথম সেটা সম্ভব করেছিলেন তা নয়। তবে ইতিহাস তাকে এভাবেই মনে রাখবে যে একজন অসাধারণ নেতা যিনি আক্রমণাত্মক নেতৃত্ব দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে জয় করেছিলেন সর্বতোভাবে! তার অর্জনের তালিকাটা এতটাই বড় যে, বলে শেষ করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link