আমার খুব শখ ছিল একটা টিনের বইয়ের বাক্স কিনবো। আমাদের সময়ে ওটাই সবচেয়ে বড় বিলাসিতা ছিল।
টিনের বাক্স তো দূরে থাক, আমার একটা সাধারণ স্কুল ব্যাগও ছিল না। বগলে বই নিয়ে হাটতে হতো কাদা মাখা রাস্তা ধরে। ফসকে একটা বই কোনোভাবে পড়ে গেলে একটা বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হতো। বাবা তাই একটা পলিথিনের ব্যাগ এনে দিলেন; ওটাতে করে বই নিয়ে যেতে হবে স্কুলে।
আকাশী নীল রংয়ের একটা ব্যাগ। ব্যাগের ওপর ঝাপসা একটা মুখ খোদাই করা।
আমি তখন উত্তম কুমারের ছবি চিনি, এমনকি রাজ্জাককেও চিনি। কিন্তু এই মুখটা কার, বুঝতে পারলাম না। আমার কাকা বললেন, ‘এই লোক হলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফুটবলার। নাম ম্যারাডোনা।’
সেই আমার ম্যারাডোনার সাথে পরিচয়। কোনো এক গ্রামের বর্ষভেজা দিনে, একটু শুকনো বারান্দায় বসে পলিথিনের ব্যাগের দিকে চেয়ে সেই আমি প্রেমে পড়ে গেলাম।
তারপর থেকে কত জল নদীতে বয়ে গেল। আমি বড় হলাম, পৃথিবীটা ছোট হল। আমার বুঝে ওঠার দুনিয়ায় রিকেলমে, রোনালদিনহো, জিদান থেকে মেসি-রোনালদো এলেন। ফুটবলের কত কী জেনে ফেললাম। কত সব বিদঘুটে শব্দ আর ট্যাকটিকস পড়ে ফেললাম। কিন্তু প্রেমটা আর বদলালো না। সেই ম্যারাডোনোতেই আটকে রইলো আমার জীবন।
আজ এই ফাঁকে সত্যি কথা বলা যাক।
৮২ তো দূরের কথা, ৮৬ বিশ্বকাপও আমি সরাসরি দেখিনি। তখন আমাদের গ্রামে টিভিই ছিল না মনে হয়। ফলে সেটা দেখাটা আমার জন্য অসম্ভব ছিল। আমার কৈশোরে ক্লাব ফুটবল দেখারও প্রশ্ন ওঠে না। ১৯৯০ সালে এসে ম্যারাডোনাকে প্রথম টিভিতে দেখলাম। ততোদিনে নামে আমি বিরাট ম্যারাডোনাভক্ত।
মজার ব্যাপার হলো, আমিও দেখা শুরু করলাম, ম্যারাডোনার জীবনেও ট্রাজেডি শুরু হয়ে গেল। নব্বইয়ের ফাইনালে সেই হার দেখলাম। এরপর ৯৪ বিশ্বকাপে সেই বিভৎস ড্রাগ ট্রাজেডি।
মাঝে ম্যারাডোনা মরেই গেছেন মলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু ফিদেল ক্যাস্ট্রোর চেষ্টায় ডাক্তাররা টেনে তুললেন। আর এই সময় থেকে ম্যারাডোনা হয়ে উঠলেন ‘ডন কোহিতো’ উপন্যাসের এক চরিত্র যেন। এই এখানে সাংবাদিক পেটাচ্ছেন, এই ওখানে বেফাঁস কথা বলছেন; রোজ রোজ বিকট সব কারণে সংবাদে আসছেন।
জর্জ বুশের মেয়ে তার সাথে হাত মেলাতে চাইলো। তিনি বললেন, যার বাবার হাতে রক্ত, সেই মেয়ের সাথে তিনি হাত মেলান না। ইভো মেরালেস, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে মিলে রীতিমতো সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করে বেড়াতে থাকলেন। ফুটবল থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন।
হঠাৎ কিভাবে যেন আর্জেন্টিনা দলের কোচ হয়ে গেলেন; আর্জেন্টিনাও তো আরেক হাস্যরসাত্মক ফেডারেশন!
খোড়াতে খোড়াতে এলেন বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের দলে জায়গা হলো না সে সময়ের বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার হ্যাভিয়ের জানেত্তি, আর মিডফিল্ডার রিকেলমের। ইন্টারের হয়ে সে বছরই ট্রেবল জেতা জানেত্তি সম্পর্কে বললেন, ‘ওর কৃতিত্ব তো মেসিকে আটকানো। এখানে তো মেসিকে আটকাতে হবে না। তাই ওকে নেইনি।’
কোত্থেকে ডেকে নিয়ে এলেন ফুরিয়ে যাওয়া ভেরনকে। বললেন, ‘ও আমার জাভি।’
বোঝেন অবস্থা।
এই হলেন ম্যারাডোনা। কখনো ড্রাগ নিচ্ছেন, কখনো নাপোলির মতো ক্লাবকে টেনে তুলছেন সেকেন্ড ডিভিশন থেকে ইউরোপ সেরার চূড়ায়, কখনো আর্জেন্টিনাকে একা বিশ্বকাপ জেতাচ্ছেন, কখনো আবার নিজেই ডোবাচ্ছেন সেই দলকে, কখনো একে মারছেন, কখনো বৌ ছাড়ছেন এবং সবসময় উল্টোপাল্টা কিছু বলছেন।
এই লোকটিকে আপনি অপছন্দ করতে পারেন, ঘৃণাও করতে পারেন; কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তাকে সবসময় আপনার মাথায় একটু জায়গা দিতে হবে।
এই আমার পাগলা ম্যারাডোনা।