‘পর্যাপ্ত হোমওয়ার্কের অভাব’-এ গাঁথা ধারাভাষ্য

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের টিভি ধারাভাষ্যকার শ্রদ্ধেয় আতহার আলী খান ও শামীম আশরাফ চৌধুরী এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর অধিকাংশ উপস্থাপিকাদের সমস্যাটা একই সূত্রে গাঁথা- ‘পর্যাপ্ত হোমওয়ার্কের অভাব’।

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ যখন চলছিলো, তখনকার কথা। টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্টস টেবিলের ছবি। শামীম আশরাফ চৌধুরী অনেক চিন্তাভাবনা করেও বের করতে পারলেন না কেন শ্রীলঙ্কার পয়েন্ট নেগেটিভ। অথচ স্লো ওভার রেটের কারণে যে পয়েন্ট কাটা যায়, এটা কমন সেন্স।

আতহার আলী খান বললেন, তিনি নাকি কোনো এক সিরিজে দেখেছেন ফ্রন্টফুট নো বল টিভি আম্পায়ার কল করেন। অথচ একজন সাধারণ দর্শক হয়েও আমি জানি যে, সুপার লিগের শুরু থেকে এই নিয়মটা চালু হয়েছে।

উপস্থাপিকাদের কথায় আসি। গত কোনো এক সিরিজে জনৈক উপস্থাপিকা অতিথিকে জিজ্ঞেস করলেন যে ইমরুল কায়েস একাদশে নেই এই বিষয়টি তিনি কীভাবে দেখছেন। অথচ ইমরুল কায়েস মূল দলেই ছিলেন না সেই সিরিজে। হোমওয়ার্কের অভাব এই উদাহরণগুলোতে প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।

শুধু আতহার আলী খান বা শামীম চৌধুরী নন, উপমহাদেশের অনেক ধারাভাষ্যকারকারই ‘ঘুম থেকে উঠে স্টুডিওতে চলে যাওয়া’র দোষে দুষ্ট। প্রায়ই দেখি তারা মাঠে প্রতিপক্ষ দলের ক্রিকেটারকে চিনতে পারছেন না, বা নামের ভুল উচ্চারণ করছেন। এমনকি নিজের দেশের ক্রিকেটারদের নামও ভুল বলছেন, যেমন, ‘তাশকিন আহমেদ’, ‘সাইফউদ্দিন আহমেদ’। অথচ হার্শা ভোগলে, সাইমন ডুলদের দেখি অন্য দেশের ক্রিকেটারদের নামের সঠিক উচ্চারণ করার জন্য চেষ্টার কমতি রাখেন না।

এটা মেনে নিতেই হবে যে, আতহার আলী খান ও শামীম চৌধুরীর টেকনিক্যাল জ্ঞান খুবই সীমিত। তবে ধারাভাষ্যে বসে সবসময়ই যে বিশ্লেষণ করতে হবে, তাও কিন্তু নয়। হার্শা ভোগলের ভাষায়, ধারাভাষ্য হচ্ছে স্টোরিটেলিং। আপনি বিশ্লেষণ করতে না পারলে প্রশ্ন করুন, ব্যাকসিট নিয়ে নিন। ভোগলে যেমনটি করে থাকেন। সুযোগ থাকলেও বিশ্লেষণের দায়িত্বটা অন্যজনকে দিয়ে দেন।

যেমন, সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তানের খেলা দেখছিলাম। ৪ বলে ১৮ প্রয়োজন। এমন সময় সিঙ্গেল নেবার সুযোগ এলেও জেসন হোল্ডারকে ফিরিয়ে দেন নিকোলাস পুরান। ধারাভাষ্যে স্যামুয়েল বদ্রি এমনই একটা ঘটনার কথা স্মরণ করলেন, যেখানে কাইরেন পোলার্ড সিঙ্গেল রিফিউজ করে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। এই ছোটখাট জিনিসগুলো ধারাভাষ্যে ভ্যালু অ্যাড করে।

কিন্তু আমাদের ধারাভাষ্যকাররা খুব একটা খেলা দেখেন বা অন্যদের ধারাভাষ্য শুনে নিজেদের দ্ক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান সিরিজে দীনেশ কার্তিকের ধারাভাষ্য শুনছিলাম। শুনলাম, তিনি পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের ব্যাপারে কথা বলার সময় সমানে পিএসএলের রেফারেন্স দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া মেয়েদের দ্য হান্ড্রেডেও খুব সাবলীল ধারাভাষ্য দিয়েছেন। এতে বুঝা যায়, একজন পেশাদার ক্রিকেটার হয়েও কার্তিক প্রচুর খেলা দেখেন নইলে ম্যাচের আগে প্রচুর রিসার্চ করেছেন।

এই রিসার্চ বা হোমওয়ার্কের ব্যাপারটা ধারাভাষ্যকারদের জন্য আরও সহজ। যদি যথেষ্ট তথ্য বা ফুটেজ না পাওয়া যায়, তাহলে সহ-ধারাভাষ্যকারদের থেকে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে নিতে পারেন তারা।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের ধারাভাষ্যকারদের এই বিরক্তিকর পারফরম্যান্সের পেছনে প্রোডাকশন হাউজের কিছু দায় রয়েছে। স্কাই স্পোর্টসে খেলা দেখার সময় আপনি ক্ষণে ক্ষণেই দুর্দান্ত পরিসংখ্যান, গ্রাফিকাল রিপ্রেজেন্টেশন দেখতে পাবেন৷ এটা ধারাভাষ্যকারদের কাজটাকে অনেক সহজ করে দেয় এবং দর্শক হিসেবে আমরাও অনেক কিছু জানতে পারি।

কারণ স্কাই স্পোর্টসের সাথে কাজ করে বেসরকারি ডেটাভিত্তিক সংস্থা ক্রিকভিজ, যারা ক্রিকেটে ডেটা সাইন্সের গ্রহণযোগ্যতাকে এক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে স্কাই স্পোর্টস, অস্ট্রেলিয়াতে ফক্স স্পোর্টস, নিউজিল্যান্ডে স্পার্ক স্পোর্টস সহ বিভিন্ন স্পোর্টস নেটওয়ার্ক ও ফ্র‍্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলোতে বিভিন্ন দল ও ব্রডকাস্টারদের ডেটা সাপ্লাই করার কাজ করছে তারা। আমাদের রিয়্যাল ইমপ্যাক্ট বা বিসিবি আদৌ এসব ব্যাপারে জানে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

আর ধারাভাষ্যে আসতে হলে যে একটা লেভেল পর্যন্ত পেশাদার ক্রিকেট খেলতে হবে সেটা আইসিসির কোন রুলবুকে আছে? তাহলে হার্শা ভোগলে, জিম ম্যাক্সওয়েল, মার্ক হাওয়ার্ড, সাইমন মান, গৌতম ভিমানিরা এত সাফল্য কীভাবে পেলেন? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কন্ঠস্বর টনি কোজিয়ার ক্রিকেট খেলেননি। একশোর উপর টেস্টে ধারাভাষ্য দেয়া নেইল ম্যানথোর্প পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন না। তবে নন-ক্রিকেটাদের ধারাভাষ্যে আসতে দিতে আমাদের কেন এত আপত্তি?

মাজহার উদ্দিন অমি টিভি ধারাভাষ্যে আমাদের নতুন সংযোজন। তার টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ আমাদের পোড় খাওয়া দুই ধারাভাষ্যকার থেকে অনেক ভালো। বিশেষ করে গত স্টিন্টে ইয়ান বিশপের সঙ্গে তার স্পেলগুলো খুবই ভালো ছিলো। তিনি পেশাদার ক্রিকেটার না হলেও একটা সময় পর্যন্ত ক্রিকেট খেলেছেন।

তবে ধারাভাষ্যে তার পদার্পণ একটা দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে ভালো ইংরেজি বলতে পারেন, খোঁজ রাখেন এবং ক্রিকেট বোঝেন- এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। শুধু প্রয়োজন তাদের বের করে সুযোগ দেয়া। আমার ধারণা বারবার টাকা দিয়ে জিম্বাবুয়ে থেকে টিনো মায়োয়ো বা ক্যারিবিয়ান থেকে টিনো বেস্টকে না এনে দেশের সম্ভাবনাময় ধারাভাষ্যকারদের সুযোগ দিলে তারা আরও ভালো করবেন।

টিভি ধারাভাষ্যে নতুন মুখের আগমন এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link