২২ মে, ২০১১। হিমালয়ের চূড়া থেকে মাত্র কিছু দূরেই এক পর্বতারোহী। প্রথম চেষ্টায় অবশ্য সফল হননি। দ্বিতীয় চেষ্টায় যেন কোনো বাঁধাই তাঁকে আটকাতে পারবে না। অক্সিজেন সমস্যায় বেশ কয়েকবার পেছপা হলেও দমে যাননি তিনি। এরপর শেষ পর্যন্ত হিমালয়ের চূড়ায় পৌঁছে নাম লেখান ইতিহাসের পাতায়।
এভারেস্টের চূড়ায় তো অনেকেই উঠেছেন, তবুও তিনি কেন ব্যতিক্রম? কারণ, সেই এভারেস্টজয়ী হলেন নিউজিল্যান্ডের অ্যাডাম প্যারোরে, সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র হিমালয়জয়ী ক্রিকেটার।
তাঁর সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষকদের একজন ছিলেন প্যারোরে। পরিসংখ্যান বিচারে ব্যাট হাতে বেশ সাদামাটা একজন মনে হলেও দুর্দান্ত কিপিং আর তার ব্যাটিং স্কিলের জন্য তখন বেশ খ্যাতি অর্জন করেন প্যারোরে। ক্যারিয়ারের শুরুতে স্রেফ একজন স্পেশালিষ্ট ব্যাটার হিসেবেই দলে সুযোগ পেয়েছিলেন!
কারণ তখন নিউজিল্যান্ডের হয়ে কিপিংয়ের নিয়মিত মুখ ছিলেন লি গারমন। পরবর্তীতে প্যারোরে লম্বা সময় পর গ্লাভস হাতে পেলেও অসাধারণ সব ডিসমিসালে বনে গেছেন নিউজিল্যান্ডের অন্যতম সেরা উইকেটকিপার হিসেবে।
২৩ জানুয়ারি, ১৯৭১। অকল্যান্ডে জন্ম নেন প্যারোরে। ১৯৮৮ সালে ১৮ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের মাত্র দেড় বছরের মাথায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অভিষিক্ত হন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার।
তিনি প্রথম ‘মাওরি’ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান। তবে বছরখানেক দলে জায়গা পাননি তিনি। নিউজিল্যান্ডের সেন্ট্রাল দ্বীপ ও প্যাসিফিক ওশেনের আদিবাসীদের মাওরি বলা হয়।
১৯৯২ এর বিশ্বকাপে ইয়ান স্মিথের অবসরের পরই একাদশের নিয়মিত মুখ হন প্যারোরে। ওই বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও অভিষিক্ত হন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্পেশালিষ্ট ব্যাটার হিসেবেই খেলানো হতো তাঁকে। ক্যারিয়ারের শুরুর কয়েক বছরে আহামরি পারফরম করতে পারেননি তিনি।
১৯৯৪ সালে ক্যারিয়ার সেরা সময় পার করেন প্যারোরে। শারজাহতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮২, বরোদায় ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত ৯৬ রানের ইনিংস ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০৮ রান ছিলো তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলো কয়েকটি।
বরোদায় ভারতের বিপক্ষে ৯৬ রানের ইনিংসের পথে গড়েন রেকর্ডও! ওয়ানডেতে এক ইনিংসে কোনো বাউন্ডারি না মেরে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের মালিক প্যারোরে! এরপর ১৯৯৫ সালে কার্টলি অ্যাম্ব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশদের সামনে অপরাজিত এক সেঞ্চুরি করেন তিনি!
সেই সময়ে উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবেই প্যারোরের ইনিংসটি বিবেচনা করা হতো। ১৯৯৭ সালে স্টিভেন ফ্লেমিং নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক হবার পর কিপিং গ্লাভস হাতে পান প্যারোরে।
পরবর্তীতে ওই সময়ের অন্যতম সেরা কিপারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এই ব্যাটার। ২০০১ সালে অজিদের বিপক্ষে ১১০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন প্যারোরে। তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা এই ইনিংস নিয়ে একবার তিনি একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
সেখানে প্রশ্নকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরি নাকি এভারেস্ট জয় কোনটা আপনার কাছে সেরা? জবাবে প্যারোরে বলেন, ‘এমন ইনিংস তো আরো খেলা যায় বা খেলেছি। তবে এভারেস্টে তো বার বার উঠা যাবে না।’
একবার এক অদ্ভুত আউটের শিকার হন প্যারোরে। ৩ মার্চ, ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডানেডিনে ব্রেট লি’র এক বাউন্সার সরাসরি প্যারোরের হেলমেটে আঘাত হানে। এতে হেলমেট খুলে সরাসরি স্টাম্পে আঘাত হানে। যার কারণে হিট আউট হয়ে ফিরতে হয় এই ব্যাটারকে।
পরবর্তীতে ২০০২ সালের এপ্রিলে প্যারোরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত জানান। ৭৮ টেস্ট আর ১৭৯ ওয়ানডেতেই শেষ হয় প্যারোরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। টেস্টে ২৬ গড়ে ২৮৬৫ ও ওয়ানডেতে করেছেন ২৬ গড়ে ৩৩১৪ রান। সাদা পোশাকে ১৪ ফিফটির পাশাপাশি করেছেন ২ সেঞ্চুরি। অপরদিকে, ওয়ানডেতে ১৪ ফিফটি সাথে আছে ১ সেঞ্চুরি।
নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল উইকেটরক্ষকদের একজন ধরা হয় প্যারোরেকে। টেস্টে ২০৪ ডিসমিসাল ও ওয়ানডেতে ১৩৬ টি ডিসমিসাল নেন এই উইকেটরক্ষক। অবসরের ৬ বছর পর ২০০৮ সালে অবসর থেকে ফিরে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএ) চেন্নাই সুপার স্টারসের হয়ে খেলেন প্যারোরে।
কে জানতো, এর তিনটি বছর পরেই কি বিস্ময় পৃথিবীর জন্য রেখে দিয়েছিলেন তিনি!