ক্রিকেটারদের জীবনে আর্থিক নিশ্চয়তার কমতি নেই হয়তো। তবে, পেশাদার ক্রিকেটারের জীবন খুব কঠিন। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নেই বললেই চলে। চাইলেই, নামকরা তারকা কোনো ক্রিকেটার সন্তানের হাত ধরে পার্কে হাঁটতে যেতে পারেন না। পারেননি প্রিয়তমার সাথে সিনেমাহলে মুক্তি পাওয়া জমাট কোনো ছবি দেখতে।
কঠোর সূচির ফাঁক গলেই জীবনের নৈমিত্তিক কাজগুলো তাঁদের সারতে হয়। এমনকি বিয়ের মত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনও। কিছু ক্রিকেটার আবার বাধ্য হন, টেস্টের মাঝেই ছোট্ট করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে। তাঁদের নিয়েই আমাদের আয়োজন। সাথে একটা ‘বোনাস’।
- আন্দ্রে নেল (দক্ষিণ আফ্রিকা)
এক শহরে ম্যাচ, আরেক শহরে বিয়ে। এই অবিশ্বাস্য কাজটাই করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলার আন্দ্রে নেল। সেটা আন্দ্রে নেলের ক্যারিয়ারের মাত্র অষ্টম টেস্ট।
আসলে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়নে টেস্টটা যে খেলতে হবে, সেটা নেল স্বপ্নেও ভাবেননি। ওই সিরিজের আগের দুই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো করেননি। ২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি, বিয়ের দিন ধার্য করা হল। সেটা ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের শেষ টেস্টের সেটি দ্বিতীয় দিন।
নেল ধরেই নিয়েছিলেন তিনি থাকছেন না। কিন্তু, নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই গোলটা বাঁধিয়ে ফেললেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম তিন টেস্টে নেন ১৭ উইকেট। তারপরও সিরিজ জিতে ফেলা দক্ষিণ আফ্রিকা চাইলে ছাড় দিতে পারতো নেলকে। কিন্তু, বাগড়া বাঁধালেন কোচ এরিক সিমন্স। আগের টেস্টেই দু’বার স্বয়ং ব্রায়ান লারাকে আউট করা বোলারকে আর কেই বা একাদশের বাইরে রাখতে চায়।
নেল তখন দোটানায়। এদিকে, কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে। সবাইকে দাওয়াত দেওয়া শেষ। চার্চ ভাড়া করা হয়ে গেছে। নেল তখন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দু’টোই করবেন।
শেষ টেস্টের দ্বিতীয় দিন আলোক স্বল্পতার কারণে দিনের খেলা আগেই শেষ হল। হেলিকপ্টারে উঠে পড়লেন নেল। চলে গেলেন বেনোনি। বিয়ে করে নতুন বউকে সময় না দিয়েই ফিরে এলেন। পরদিন মাঠে নামলেন। পেলেন ব্রায়ান লারা, শিবনারায়ন চন্দরপল ও রিডলি জ্যাকবসের উইকেট। পরের ইনিংসেও লারার উইকেট পেয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা সেই ম্যাচ জিতে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
- ক্লাইড বাটস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
টেস্টে তো বিশ্রামের দিনই বিরল। সেই দিনটা পেয়ে বিয়ে করে ফেলার নজিরও আছে। সেটা করেছিলেন একজন। তিনি ক্লাইড বাটস, গায়ানিজ অফস্পিনার। অভিষেক টেস্টে কিংবা টেস্টের বিরতির দিনে বিয়ে করা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। এটাকেও একটা রেকর্ডই ধরা যায়।
ক্রিকেটের খবর যারা রাখেন, তাঁদের কাছেও ক্লাইড বাটসের নাম খুব পরিচিত নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে এই অফ স্পিনারের ক্যারিয়ার থেমে যায় মাত্র সাত টেস্টেই। তার ওপর রজার হার্পার ছিলেন। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো বরাবরই পেস নির্ভর দল।
১৯৮৫ সালের ছয় এপ্রিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জর্জটাউনে তাঁর অভিষেক হয়। নয় এপ্রিল ছিল বিরতি। সেদিনই বিয়ে করেন বাটস। যদিও, বিয়েটা তাঁর জন্য সেই টেস্টে কোনো সৌভাগ্য আনেনি। উইকেট শূন্য ছিলেন।
এরপর খেলতে পারেন আর মাত্র ছয় টেস্ট। ক্যারিয়ার শেষ করেন ১০ টি টেস্ট উইকেট নিয়ে। সাথে করেন ১০৮ রান। যদিও, প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার তাঁর বেশ সমৃদ্ধ। ৮৭ টি ম্যাচ খেলে নেন ৩৪৮ টি উইকেট। দু’টো হাফ-সেঞ্চুরিও করেন। ২০০৮ সালে তিনি ক্যারিবীয়ানদের নির্বাচক প্যানেলের প্রধান ছিলেন।
- বোনাস: টনি পিগট (ইংল্যান্ড)
পুরো নাম অ্যান্থনি চার্লন শ্যাকলটন পিগট, ডান-হাতি পেসার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর প্রথম তিন উইকেটই ছিল পরপর তিন বলে, মানে হ্যাটট্রিক। তবে, পিঠের চোটের কারণে জাতীয় দলে সুযোগ আসছিল না। কিন্তু, হঠাৎ করেই যখন সুযোগ এল তখন তার জন্য রীতিমত বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দিতে হল।
সেটা ১৯৮৪ সাল। ইংল্যান্ড দল তখন নিউজিল্যান্ড সফরে। দ্বিতীয় টেস্টের আগেই চোটজর্জর দল। নিল ফস্টার ও গ্রাহাম ডিল – দুই পেসার এক সাথে ইনজুরিতে। দলে ইয়ান বোথাম, বব উইলিস ও নর্ম্যান কাওয়ান্স থাকলেও আরেক পেসার চাই টিম ম্যানেজমেন্টের। কারণ, ক্রাইস্টচার্চের উইকেট বড্ড পেসারবান্ধব।
কিন্তু, এই সময় ইংল্যান্ড থেকে উড়িয়ে আনার সময় কোথায়। ওয়েলিংটনে তখন ক্লাব ক্রিকেট খেলছিলেন টনি পিগট। তাকে ডেকে পাঠানো হল।
পিগট তখন দলে ডাক পাওয়ায় আনন্দিত না হয়ে বরং দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। টেস্টের চতুর্থ দিনই যে তাঁর বিয়ে। কিন্তু, টেস্টের সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়।
কষ্টেসৃষ্টে হবু স্ত্রীকে রাজি করালেন, বিয়ে পেছানো হল। স্বপ্নের টেস্ট খেলতে নামলেন পিগট। অভিষেকের সপ্তম বলেই উইকেট সহ নেন দুই উইকেট। কিন্তু, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির অতিমানবীয় অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ইনিংস ব্যবধানে হারে। দুই ইনিংসের কোনোটাতেই ইংল্যান্ডের দলীয় রান ১০০ ছোয়নি।
পিগটের দ্বিতীয় ইনিংসে আর বোলিং করা হল না। তবে, আরও দু:খজনক ব্যাপার হল টেস্ট শেষ হল তিন দিনেই। চতুর্থ দিনে বিয়ের দিন ছিল তাঁর। বিয়েটা না পেছালেও পারতেন। তবে, আক্ষেপ আরও আছে তাঁর। আর কোনোদিনও টেস্ট খেলাই হয়নি ২৬০ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৬৭২ টি উইকেট পাওয়া পিগটের।