একজন নারী কী ভীষণ রহস্যের চাদরে ঘেরা একটি স্বত্বা। কখনো কোমল হন, ভালোবাসায় সিক্ত করেন কখনো আবার ভীষণ কঠিন। একজন নারীর পক্ষেই সম্ভব একটা জীবনে এতগুলো রূপ নিয়ে বাঁচা, এতগুলো দায়িত্ব সামলে উঠা। তবে এইসবকিছুই একটা বিন্দুতে গিয়ে মেশে।
সেটা হচ্ছে মাতৃত্ব। এই পৃথিবীর সবকিছুকে যে শব্দটা দিয়ে আলাদা করা যায়।
একজন মাকে একা হাতে কত দায়িত্বই না সামলাতে হয়। তবুও এই মাতৃত্ব সামলে নিজেদের পথচলাটাকে কখনো থেমে যেতে দেননা। ক্রিকেট মাঠেও আছে এমন সব মায়েদের পদচারণা। একজন মা হয়ে ক্রিকেট মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোটা রীতিমত অবিশ্বাস্যই বটে। কেননা ক্রিকেট খেলতে হলে শারীরিক ফিটনেসটাও ভীষণ জরুরি।
ফলে অনেক কিছুর বিনিময়েই মায়েদের মাঠে নামতে হয়। ক্রিকেট মাঠে শরীরটা একজন ক্রিকেটারের অন্যতম সম্পদ। এছাড়া নারী ক্রিকেটারদের ফিটনেস নিয়ে গবেষণায়ও ঘাটতি আছে। আর অনেক দেশের বোর্ডও এই ব্যাপারে উদাসীন।
ফলে গর্ভকালীন সময়টা কাটিয়ে উঠার পরেই লড়াইটা শেষ হয় না। এরপর আবার নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য ফিট করে তুলতে হয়। মাতৃত্বের দায়িত্ব সামলে ক্রিকেটের জন্য সময় বের করতে হয়।
আর জন্মের পরপরই একজন শিশু যখন তাঁর মাকে পায়না সেটা শিশুর মানসিক বিকাশেও অনেকটা বাঁধা দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর একটা বড় সময় মায়ের সাথে থাকতে হয়।
তবুও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনন্য কিছু উদাহরণ তৈরি করেছেন কয়েকজন নারী ক্রিকেটার। এবছর নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই ব্যাপারটি নতুন করে সামনে এনেছেন পাকিস্তানের নারী ক্রিকেটার বিসমাহ মারুফ।
নিজের ছোট্ট শিশুকে সাথে নিয়েই বিশ্বকাপের মঞ্চ মাতাচ্ছেন। সেই দৃশ্য দেখে পুরো দুনিয়া আরেকবার ভাবছে মাতৃত্বর সংজ্ঞাটা ঠিক কত বড়, মাতৃত্বের সীমানাটা ঠিক কোথায় গিয়ে থামে।
তবে শুধু বিসমাহ মারুফই নন। এবারের নারী বিশ্বকাপে মোট ৮ জন মা খেলছেন। নিউজিল্যান্ডের স্যাটার্থওয়েট ও তাহুহু, অস্ট্রেলিয়ার মেগান স্কুট ও র্যাকেল হায়নেস, দক্ষিণ আফ্রিকার লিজেল লি, মাসাবাতা ক্লাস, পাকিস্তানের বিসমাহ মারুফ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের অ্যাফি ফ্ল্যাচাররাও বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন নিজেদের সন্তানকে রেখে।
আসলে দেশ থেকে দূরে যাওয়ার দরকার কি। বাংলাদেশের সাথিরা জাকির জেসির কথাই ধরুণ না। জাতীয় দলের সাবেক এই সহ-অধিনায়ক দিব্যি সন্তান নিয়েই ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি প্রথম বাংলাদেশি নারী ধারাভাষ্যকার। এর বাদে এখনও তিনি ঘরোয়া লিগের ম্যাচ খেলেন।
যেমন বিসমাহ মারুফ গর্ভধারণ করার আগেই ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। তিনি সন্তান সম্ভাবা হবার পর থেকে এই পুরো সময়টায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তাঁর পাশে ছিল। প্রথমেই তাঁকে ছুটি দিয়ে দেয়া হয় এবং বলা হয়েছিল বিসমাহ মারুফ মা হবার পর আবার ক্রিকেট খেলার মত শারীরিক অবস্থা হলেই তাঁকে কন্ট্রাক্টে নিয়ে আসা হবে।
হয়েছেও তাই, এমনকি তিনি আবার নিজেকে মাঠে প্রমাণ করার পর তাঁর অধিনায়কত্বও ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর আজ সেই মা বিসমাহ মারুফই বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এরপরও অবশ্য বাঁধা ছিল। এই ছোট্ট শিশুকে রেখে বিসমাহ মারুফ এতদিন বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন কী করে? তাই দলের সঙ্গে তাঁর মেয়েকেও রাখা হয়েছে। তবে ম্যাচ চলার সময় মেয়েটা কার কাছে থাকবে। সেজন্য আবার বিসমাহ মারুফের মা কেও দলের সঙ্গে রাখা হয়েছে। এভাবেই চলছে তিনটি প্রজন্মের বিশ্বকাপ যাত্রা। এভাবেই বিসমাহ মারুফরা জানান দিয়ে যাচ্ছেন মাতৃত্ব ও নারীর সংজ্ঞা।
তবে সবাই তাঁদের ক্রিকেট বোর্ড থেকে বিসমাহ মারুফের মত সহযোগিতা পায় এটা ভাবা ভুল হবে। বিশেষ করে উপমহাদেশের দেশগুলোতে নারী ক্রিকেটারদের একটি কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। লড়াইটা তাঁদের শুধু মাঠে করার কথা ছিল, অথচ ওই মাঠ পর্যন্ত পৌছাতেই তাঁদের লড়তে হয়ে গোটা একটা সমাজের সাথে। তবুও এই মাতৃত্ব থামতে জানেনা, এই মাতৃত্ব লড়াই ছাড়েনা।