নো-বল বিতর্কের লেলিহান শিখা

ক্রিকেট দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল।

বলা হচ্ছিল বর্ণবাদের সময়ের পর ক্রিকেট এতো বড় এক ধাক্কা আর হজম করেনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটের বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, উপমহাদেশ সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে পারে বাকি বিশ্বের সাথে; অন্তত অস্ট্রেলিয়ার সাথে।

আর পুরো এই ঘটনার ‘ভিলেন’ হিসেবে কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ড্যারেল হেয়ার। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার।

এরকমই এক বক্সিং ডে টেস্টের ঘটনা। আজ থেকে দুই যুগেরও বেশি সময় আগের কথা। সেই টেস্টে ড্যারেল হেয়ার সাত, সাত বার মুত্তিয়া মুরালিধরনের বলে নো-বল কল করেন। নো বল হলে সাত বার কেন, সত্তর বারও কল করা যেতে পারে। কিন্তু, হেয়ার বারবারই কলটা করছিলেন অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের কারণে। যেখানে মাঠে একবারও এমন কল করতে দেখা যায় না আম্পায়ারদের।

এক পর্যায়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গা দলবল নিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যেতেও উদ্যত হয়েছিলেন। এর আগে পরে ক্রিকেট বিশ্বে বহু ঘটনা ঘটেছে। অধিনায়কের নাম রানাতুঙ্গা বলেই তিনি বিষয়টা নিয়ে ছিলেন বেশ সিরিয়াস।

মুরালি ধরন দফায় দফায় আইসিসির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন মুরালির জন্মগতভাবেই হাতের অ্যাকশন বাঁকা। ফলে তাকে নো-বল ডাকা ঠিক না। আইসিসিও এটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু হেয়ার ছিলেন অনঢ়। তিনি এমনকি নো বল ডাকার সুবিধার জন্য খেলা চলা অবস্থায় দুই বার নিজের অবস্থানও পরিবর্তন করেছিলেন। ফলে এটা রটে গিয়েছিল যে, এই পুরো ব্যাপারটা একটা চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়। এমনকি হেয়ার একজন বর্নবাদী, এমন ভয়াবহ অভিযোগও উঠে পড়ে।

এতোদিন পর হেয়ার বলছেন, তার আসলে নো বল না কল করে উপায় ছিল না। তিনি চোখের সামনে এই ‘অন্যায়’ দেখে যেতে পারছিলেন না। মুরালির অ্যাকশনের বিষয়ে ড্যারেল হেয়ারের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার।

তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য ছিল, হয় তোমাকে থামতে হবে; না হয় পরিবর্তন করতে হবে। আমাকে কঠোর হতেই হত। যখন ছয় বা সাত উইকেট পড়ে যায়, সে বল করতে আসে, আমার মনে হত ডেলিভারিগুলো ইললিগ্যাল ছিল। আমি যদি ওকে ওভাবেই বল করতে দিই, তাহলে তো আমি আমার কাজটা করছি না। এভাবে চলতে দিলে সেটা তো কোন আম্পায়ারের কাজ হল না।’

ড্যারেল হেয়ার কথা বলেছেন মাঠে থাকা অন্য আম্পায়ারদের নিয়েও। তার ধারণা, মাঠের অন্য আম্পায়ার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না। তবে সবাই তার সাথে একমত ছিলেন বলেই দাবি করেছেন হেয়ার, ‘অন্য আম্পায়ারেরাও ব্যাপারটা দেখেছিল, কিন্তু কেউই ফাইনাল স্টেপ নিতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু সবাই জানত, কিছু একটা গোলমাল আছে। এরকম কিছু বুঝলে আমি চুপ থাকতে পারি না।’

সে ম্যাচটাতে মুত্তিয়া মুরালিধরণ ৩৮ ওভার বল করে ১২৪ রানের খরচায় এক উইকেট নেন। সে ম্যাচটাতে অস্ট্রেলিয়া ১০ উইকেটের বিশাল জয় তুলে নিতে সমর্থ্য হয়।

ড্যারেল হেয়ার মাঠে অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার সাথে মুত্তিয়াকে ডাকেন। আর অন্যপাশে থাকা কিউই আম্পায়ার স্টিভ ডুনের সাথে জায়গা বদল করেন। এই যে স্টিভ ডুনের সাথে ড্যারেল হেয়ার জায়গা বদল করেন, এটা তিনি কেন করেছিলেন?

ড্যারেল হেয়ার বলেছেন, ‘মুত্তিয়ার অ্যাকশন দেখতে হলে বোলারের পেছন থেকেই দেখা ভাল। আমি জানি ব্যাপারটা হয়তো ভাবনার খোরাক যোগাবে, কিন্তু আমি ওটাই ভাল মনে করেছিলাম। স্কয়ার লেগে দাঁড়িয়েও বোলারের অ্যাকশন দেখা যায়। কিন্তু আমি একটু অন্যভাবে দেখতে চাইছিলাম। সে কিছু লিগ্যাল ডেলিভারিও করেছিল। সেগুলো খতিয়ে দেখতে তো আমাকে বোলারের পেছনেই দাঁড়াতে হবে।’

১৯৯৫ সালের সে টেস্টটাতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ছিলেন মার্ক টেইলর। মার্ক টেইলরের ভাষ্যমতে তিনি রীতিমত চমকে গেছিলেন। মার্ক টেইলর অবশ্য বলেছেন, কব্জির অ্যাকশনে সমস্যা থাকলে নো বল ডাকতেই পারেন আম্পায়ারেরা।

মার্ক টেইলর আরো বলেছেন, ‘মানুষ ড্যারেলকে নিয়ে যাই বলুক, তিনি সেটাই করেছেন যেটাকে ঠিক মনে করেছেন। সবাই-ই মুরালির অ্যাকশন নিয়ে কথা বলছিল। ড্যারেলই দেখতে চাইছিল মুরালি ঠিক নাকি ভুল । তাই সে এটা করেছিল। সে যেটা ঠিক মনে করেছে সেটাই করেছে।’

মার্ক টেলর যাই বলুন, এশিয়ান দলগুলোর সাথে হেয়ারের ঝামেলার এখানে শেষ বা শুরু হয়। এর আগেও অনেকবার তিনি ভার-পাকিস্তানের সাথে সমস্যা তৈরী করেছেন। ২০০৬ সালে আরেক কুখ্যাত ঘটনায় তিনি ওভালে পাকিস্তানকে ৫ রান জরিমানা করেন। অভিযোগ ছিল পাকিস্তান বল টেম্পারিং করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে পাকিস্তান দল ইনজামাম-উল-হকের নেতৃত্বে মাঠ ছেড়ে চলে যায়।

আইসিসি এই ঘটনার পর ম্যাচের ফলাফলে ৩ বার পরিবর্তন আনে। ম্যাচ পরিকত্যাক্ত, ড্র ও পাকিস্তান পরাজিত; এমন করে বারবার ওই ম্যাচের ফল বদলানো হয়েছে বিভিন্ন সময়। শাস্তি পান স্বয়ং ইনজামাম উল হকও।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link