ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচাইতে গ্রেসফুল ব্যাটসম্যান কে? এই প্রশ্নের উত্তরে কেবল একটা নামই আসা উচিত, ডেভিড গাওয়ার। যিনি ব্যাট করতেন ছবির মত, কবিতার মত৷ ইংরেজিতে একটা কথা আছে, পোয়েট্রি ইন মোশান। গাওয়ারের ব্যাটিং ছিল ঠিক সেই রকম, শিল্প ও নান্দনিকতাই যার শেষ কথা।
সোনারঙা কোঁকড়া চুলের অধিকারী, সুদর্শন, হালকা লিকলিকে গড়নের বাঁ-হাতি গাওয়ার ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। তাঁর টাইমিং ছিল রেশমের মত কোমল, মোলায়েম। সচরাচর ‘টাচ প্লেয়ার’দের বেলায় যেমনটা বলা হয় আর কি ৷ টাচ প্লেয়াররা নাকি বলকে আঘাত করেন না, স্রেফ পরশ বুলিয়ে দেন।
ক্লাসিক্যাল গাওয়ার জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর ফ্রি-ফ্লোয়িং কাভার ড্রাইভ, এফোর্টলেস পুল আর চুলচেরা নিখুঁত লেট কাটের জন্য।
সাবেক ইংরেজ ব্যাটসম্যান এড স্মিথের ভাষায়, ‘Did you see that ‘exquisite’ David Gower cover drive? He never looked like he’s trying, it’s so effortless.’
বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে পিটার রোবাক প্রায়ই বলতেন, ‘Gower never moves, he drifts.’
গাওয়ারের আত্মজীবনীর লেখক মার্টিন জনসনের ভাষায়, ‘His first ball in Test cricket was pulled majestically for four. At times there were strokes that made you despair, and strokes that were the stuff of poetry.’
গাওয়ারের ব্যাটিং স্টাইল, ফ্লেয়ার নিয়ে তো অনেক কথা হল, এবার পরিসংখ্যান নিয়ে বসা যাক৷ চৌদ্দ বছরের নাতিদীর্ঘ ক্যারিয়ারে গাওয়ার খেলেছেন ১১৭ টেস্ট; ৪৪.২৫ গড়ে রান করেছেন আট হাজার ২৩১। শতক হাঁকিয়েছেন ১৮টি, অর্ধ-শতক ৩৯টি। সর্বোচ্চ ২১৫, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৮৫ সালে এজবাস্টনে।
এছাড়া ১১৪টি আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচে ৩০.৭৭ গড়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন তিন হাজার ১৭০ রান। ৭টি সেঞ্চুরির পাশে এক ডজন হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ১৫৮, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৮৩ সালে ব্রিসবেনে।
অনেকেই হয়ত জানেন না, ওয়ানডেতে এক পঞ্জিকাবর্ষে সহস্রাধিক রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান হলেন ডেভিড গাওয়ার। ১৯৮৩ সালে চার সেঞ্চুরি ও চার ফিফটিতে ৬৩.৮৮ গড়ে ১০৮৬ রান করেছিলেন গাওয়ার। স্ট্রাইক রেট ছিল ৮৬.৪৬!
১৯৮৩ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন তিনি। ৬৪ গড়ে করেছিলেন ৩৮৪ রান।
অধিনায়ক হিসেবে ইংলিশদের পক্ষে এক সিরিজে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেন ডেভিড গাওয়ার। ১৯৮৫ সালের অ্যাশেজে নয় ইনিংসে ব্যাট করে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৭৩২ রান।
অধিনায়ক হিসেবে অ্যাশেজে তার চেয়ে বেশি রান আছে কেবল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। ১৯৩৬-৩৭ মৌসুমে নয় ইনিংস খেলে ব্র্যাডম্যান করেছিলেন ৮১০ রান।
বিখ্যাত ‘সামার অব এইট্টি ফাইভে’ গাওয়ারের অনবদ্য ব্যাটিং নৈপুণ্যেই ইংরেজরা অ্যাশেজ জিতেছিল ৩-১ ব্যবধানে।
১৯৭৮ সালের জুনে পাকিস্তানের বিপক্ষে গাওয়ারের টেস্ট অভিষেক, একুশ বছর বয়সে। ১৯৯২ সালের আগস্টে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট।
ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ইনিংসের প্রথম বলেই নয়নাভিরাম এক পুল শটে চার মেরে। বোলার ছিলেন পাকিস্তানের লিয়াকত আলী। শর্ট পিচ বল; শরীরের নিচের অংশটা স্থির রেখে মোহনীয় ভঙ্গিমায় পুল করলেন গাওয়ার। চার! শটটা ছিল একই সাথে বোলারের মৃদু অপমান আর দর্শনার্থীদের চিত্ত হরণের অনুষঙ্গ!
এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব? কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব, সেটা আলাদা করতেই যেন ভিরমি খেয়েছেন সবাই। পরবর্তী কয়েক বছরের বিনোদনের খোরাক যেন দেখা মিলেছিল এক শটেই।
অভিষেক ইনিংসে গাওয়ার করেছিলেন ৫৮। তবে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসটা হয়তো মনেই রাখতে চাইবেন না গাওয়ার। ছয় বল খেলে মাত্র ১ রান করে ওয়াকার ইউনুসের রিভার্স সুইংয়ে বোল্ড হয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। আসলে বিদায় বেলাটা সবাই রাঙিয়ে যেতে পারেন না। যেমনটা পারেননি সুন্দরের পূজারী ডেভিড গাওয়ারও!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ক্রীড়া বিশ্লেষক এবং টেলিভিশন সঞ্চালকের ভূমিকাতেও দারুণ জনপ্রিয় ডেভিড গাওয়ার। স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার হিসেবেও ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখা এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ২০০৯ সালে জায়গা করে নেন আইসিসি ‘হল অব ফেমে’।
ডেভিড গাওয়ার কেবল ব্যাট কিংবা মাইক্রোফোন হাতে নয়, কলম হাতেও যথেষ্ট সপ্রতিভ। ক্রিকেট নিয়ে পত্রিকায় কলাম লেখার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ১৯৯২ সালে দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের রিপোর্টার মার্টিন জনসনের সাথে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Gower: The Autobiography এবং ১৯৯৫ সালে অ্যালেন লি’র সাথে লিখেছেন David Gower: With Time to Spare। এছাড়াও জনসনের সাথে Can’t Bat, Can’t Bowl, Can’t Field নামে আরেকটি বই লিখেছেন তিনি।
শেষ করব একটা মজার পরিসংখ্যান দিয়ে ৷ টেস্ট ক্যারিয়ারে একবারও শূন্য রানে আউট না হয়ে একটানা সবচেয়ে বেশি ইনিংস খেলার রেকর্ডটি ডেভিড গাওয়ারের। ১৯৮২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ১৯৯০ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১১৯ ইনিংস ‘শূন্যবিহীন’ ছিলেন গাওয়ার!