একজন ‘নেলসন’ কিংবদন্তি

১৯৮৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে অভিষিক্ত হলেন দৈত্যকার এক আম্পায়ার।

আম্পায়ার বলতে আমরা বুঝি গম্ভীর প্রকৃতির একজন মানুষ। কড়াভাবে যিনি খেলাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং সিদ্ধান্ত জানাবেন, তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য! ক্রিকেট মাঠে সিদ্ধান্ত দেবার দায়িত্ব পাওয়া এই মানুষটা তার আচরণ, উদযাপন আর হাস্যরসের দরুন প্রিয় বনে গেলেন সকলেরই।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন; বলছিলাম কিংবদন্তি আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ডের কথা। সেই নেলসন উদযাপনের আম্পায়ার। যিনি কিনা ক্রিকেট খেলাটিকে পরিচালনার পাশাপাশি মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছেন।

ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য ভক্তদের মূল উদ্দেশ্য হলো খেলোয়াড়দের চমকপ্রদ শৈলী উপভোগ করা। কিন্তু খেলোয়াড় না হয়েও যেই ব্যক্তিটি সমানভাবে সকলের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তিনিই ডেভিড শেফার্ড। খেলোয়াড়দের সাথে তার খুনসুটিতে মেতে ওঠা কিংবা কোনো দলের রানসংখ্যা ১১১ হলেই এক পা তুলে বিখ্যাত নেলসন ডান্স, নব্বই দশকে ভক্তরা ক্রিকেট দেখেছেন কিন্তু তার এই হাস্যরসগুলো দেখেননি এটা মানা যায়না। ব্যাট-বলের শৈলী নয়, খালি হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে মাঠে নামা এই মানুষটা কতোশতো ভক্তের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তা গুণে শেষ করা যাবেনা।

১৯৪০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ডেভনের বাইফোর্ডে জন্ম হয় শেফার্ডের৷ বাবা ছিলেন একজন সাব-পোস্টমাস্টার। তবে প্রথম জীবনে কাজ করতেন মার্চেন্ট নেভীতে।  মোটামুটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন শেফার্ড। ক্রিকেটের প্রতি টানটা আসে মূলত বাবার হাত ধরেই। বাবা রাগবি ভক্ত হলেও অবসরে ক্রিকেটও খেলতেন। সেই সুবাদেই ক্রিকেটকেই শৈশব-কৈশরের প্রথম প্রেম হিসেবে বেছে নেন ডেভিড শেফার্ড। তবে গ্লুস্টারশায়ারের হয়ে প্রফেশনাল ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হলেও বেশ দেরীতেই মূল দলে যায়গা পেয়েছেন তিনি। প্রায় পঁচিশ বছর বয়সে মূল দলে ডাক পান শেফার্ড।

খেলোয়াড়ি জীবনেও ভীষণ মজার মানুষ ছিলেন ডেভিড শেফার্ড। সতীর্থ আর সমর্থকেরা তাকে কাছে না পেলে যেন শান্তিই পেতেন না। ব্রিটিশরা ক্রিকেট খেলা সাধারণত গম্ভীর হয়েই উপভোগ করতো। চা-পানীয় খেয়ে কিংবা পত্রিকা পড়ে তারা খেলার মাঠে সময় কাটাতো। এমনই এক দর্শক মাঠে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন, ব্যাটসম্যান শেফার্ড হাঁকালেন বিশাল এক ছক্কা। ব্যস, গিয়ে পড়লো সেই লোকের গায়ে। শেফার্ডের এক ছক্কার কারণে সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো। এটা খেলোয়াড়ি জীবনে শেফার্ডকে খুব নাড়া দেয়।

এক ক্লাবে (গ্লুস্টারশায়ার) থেকেই পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন শেফার্ড। প্রায় ১৪ বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে ২৮২ টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন তিনি; রানসংখ্যা প্রায় এগারো হাজার ছুঁই ছুঁই। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসটি ছিলো ১৫৩ রানের।

খেলা ছাড়লেও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কমেনি এতোটুকুও, বরং বেড়েছে সিন্ধু সমান। তাই তো তিনি উপায় খুঁজছিলেন কিভাবে ক্রিকেটের সংস্পর্শে থাকা যায়। প্রথমে ভাবলেন ক্রিকেট কোচ হবেন, খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেয়ার সুবাদে ক্রিকেটের মাঝেই থাকা হবে। কিন্তু এক বন্ধু হঠাৎই পরামর্শ দিলেন, আম্পায়ার হয়ে যারা মাঠে ঢোকে তারা নাকি সবচাইতে ভালো জায়গা থেকে খেলা দেখার সুযোগ পায়! বন্ধুর এই কথাটি মনে ধরে যায় শেফার্ডের। এটাই তার আম্পায়ার হয়ে ওঠার গল্প। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার মাত্রা কতোটা তীব্র হলে মানুষ এমন কাণ্ড করতে পারেন তা বোঝাটা দুস্কর’ই বটে।

 

আম্পায়ার হিসেবে ডেভিড শেফার্ড যাত্রা শুরু করেন ১৯৮১ সালে ফার্স্ট ক্লাস এক ম্যাচে৷ এরপরে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ওয়ানডে অভিষেক হয় তার। তার দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে নিজ দেশ ইংল্যান্ডের ওল্ড ট্রাফোর্ডে ঐতিহাসিক অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক হয় তার। এই থেকেই শুরু ক্রিকেটে তার দ্বিতীয় ইনিংস।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের ধারণাটা পুরোপুরিভাবে বদলে দিতে সক্ষম হন এই মোটাসোটা মানুষটা। মজার ভঙ্গিতে চারের সঙ্কেত দেয়া এই মানুষটা খুব দ্রুতই আপন করে নিয়েছিলো ক্রিকেট দুনিয়া। বাইশ বছরের আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে তিনি পরিচালনা করেছেন ৯২টি টেস্ট আর ১৭২টি ওয়ানডে ম্যাচ। ছয় ছয়টি বিশ্বকাপে ক্রিকেট মাঠে নেমেছিলেন শেফার্ড। ২০০৫ সালে বিদায় জানান আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারকে।

আনলাকি ট্রিপল ওয়ান ব্যাপারটাকে খুব মানতেন।

১১১ বা নেলসন সংখ্যাটাকে ভীষণভাবে অপয়া মনে করতেন ডেভিড শেফার্ড। কারণ তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কুসংস্কার’কে খুবই বিশ্বাস করতেন। এর জন্যেই তিনি মাঠে থাকলে দলের স্কোর ১১১ হলেই এক পা তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইতেন, যতোক্ষণ না স্কোরবোর্ডে পরিবর্তন আসছে। নেলসন ডান্স নামে পরিচিত এই ভঙ্গিমা দর্শক মহলে ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। আরেকটা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন তিনি, প্রতি মাসের ১৩ তারিখ  পকেটে সারাদিন ম্যাচের কাঠি নিয়ে ঘুরতেন আর আঙ্গুল ছোঁয়াতেন; এটা নাকি সৌভাগ্য বয়ে আনবে।

১১১ নিয়ে তার জীবনে মজার ঘটনাও ঘটেছে। ভারত সফরে একবার ১১১ নম্বর হোটেল কক্ষ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেফার্ড সে কক্ষ নিতে নারাজ। শেষমেশ তার জেদের কাছে হার মানে কতৃপক্ষ; পরিবর্তন করা হয় কক্ষ।

২০০৫ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজে অবসরের ঘোষণা দেন শেফার্ড। তখন দুই দলের খেলোয়াড়েরা গার্ড অফ অনার দিয়েছিলো তাকে। শেষ ওয়ানডেতে কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার নিকট উপহারস্বরূপ ক্রিকেট ব্যাট উপহার পেয়েছিলেন শেফার্ড। অ্যাশেজে শুরু, অ্যাশেজেই শেষ। ওভালে অ্যাশেজেই টেস্টকে বিদায় জানান এই কিংবদন্তী। বিদায়টাকে জাকজমকপূর্ণ করতে চেয়েছিলো আইসিসি। কিন্তু তাতে রাজি হননি শেফার্ড, নাকচ করে দেন সোজাসুজি।

আরেক বিখ্যাত আম্পায়ার সাইমন টাফেল তার সম্পর্কে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ডেভিড শেফার্ড হচ্ছেন স্পিরিট অফ ক্রিকেট। পরিচালনার দক্ষতা কিংবা হাস্যরসে সবার মন জয় করা, এটা সবাই উনাকে দেখেই শিখেছি। খেলোয়াড়েরা উনাকে সম্মান করে এবং সেই সম্মানটা তিনি নিজ গুণেই অর্জন করেছেন।’

অবসরের পরে ডেভিড শেফার্ড সমুদ্রতীরবর্তী এক গ্রামে চলে যান এবং ভাইয়ের পোস্ট অফিসে পার্ট টাইম কাজ করতেন। ফুসফুসের ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর ডেভবে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী।

ক্রিকেটার না হয়েও যে ভালোবাসা কুড়ানো যায় তার জ্বলন্ত উদাহারণ হলেন শেফার্ড। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ক্রিকেটের প্রতি যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়েছেন তার মান রেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। এখনও ক্রিকেটবিশ্ব কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ রেখেছে ডেভিড শেফার্ডকে।

খেলাটা যে কেবল সিরিয়াস একটা ব্যাপার নয়; এটা একাধারে পেশাদার এবং বিনোদনের ব্যাপার, সেটা আমাদের বুঝিয়ে যেতে পেরেছেন শেফার্ড।

লেখক পরিচিতি

আকাশমুখো দুরন্ত মেঘেদের গল্প লিখার আশ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link