বিবি নিম্বলকর, ব্র্যাডম্যানকে না ছোঁয়ার আক্ষেপ

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহারথী। ব্র্যাডম্যানকে সম্মান জানিয়ে ৩৩৪ রানে অপরাজিত থেকে মার্ক টেলর ইনিংস ঘোষণা করলে প্রশংসা কুড়োন সারা বিশ্বের। কিন্তু আড়ালে রয়ে গেলেন ভাগ্যের মারপ্যাঁচে পড়ে ডনকে পেছনে ফেলতে না পারা এক ভারতীয়। তিনি ভাউসাহেব বাবাসাহেব নিম্বলকর। ১৯৪৮ সালে মহারাষ্ট্রের হয়ে করা তার অপরাজিত ৪৪৩ রানের রেকর্ড এখনো পর্যন্ত ভাঙতে পারেননি কেউ।

২৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নিম্বলকার ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে রানমেশিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৭.৯৩ গড়ে ৪,৮৪১ রান করেন। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি কার্যকরী মিডিয়াম পেসার হিসেবে খ্যাতি ছিল তার, এমনকি দলের প্রয়োজনে উইকেটের পেছনেও দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করতেন নাহ। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত রান করে গেলেও ভারতীয় জাতীয় দলে কখনো ডাক পাননি। তবে ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে কমনওয়েলথ দলের বিপক্ষে অনানুষ্ঠানিক একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন তিনি।

‘এটা নিছক অন্যায় যে আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পাইনি। আমি একটি অনানুষ্ঠানিক টেস্ট খেলেছি এবং তাদের আমার দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। আমি দেশকে ভালো কিছু দিতে পারতাম। এটি আমার ভাগ্যে ছিল না’, অবসরের কয়েক বছর পরে নিম্বলকার মন্তব্য করেছিলেন।

‘কেন জানি নির্বাচকরা আমাকে বিবেচনা করতেন নাহ। আমাকে সত্যিই কষ্ট দিয়েছে যে, কিছু কম প্রতিভাবান খেলোয়াড়ই দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিল।’, যোগ করেন তিনি।

তবে আন্তর্জাতিক টেস্ট না খেললেও নিম্বলকার ঠিকই ইতিহাসে জায়গা পেয়েছেন। ১৯৪৮ সালে তার করা অপরাজিত ৪৪৩ রানের ইনিংস কখনো টেস্ট না খেলা ক্রিকেটারের পক্ষে সর্বোচ্চ। এই অনবদ্য ইনিংসটি সাক্ষ্য দেয় কতটা উঁচুমানের ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের রঞ্জি ট্রফিতে মহারাষ্ট্র বনাম কাঠিওয়ারের ম্যাচটা কেবল নিম্বলকরের ইনিংসের জন্যই নয় বরং আরো নানা কারণে বিখ্যাত। নিম্বলকার ব্র্যাডম্যানকে ছাড়িয়ে যাবেন এই আশংকায় ম্যাচ ছেড়ে দেয় কাঠিওয়ার। খেলাধুলার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।

পুনা ক্লাব মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া চারদিনের ম্যাচের প্রথম দিনেই কাঠিওয়ার ২৩৮ রানে অলআউট হয়ে গেলে ব্যাটিংয়ে নামে মহারাষ্ট্র। প্রথম দিন শেষে মহারাষ্ট্রের সংগ্রহ ছিল এক উইকেট হারিয়ে ১৩২রান। ৮১ রানে প্রথম উইকেটের পতন ঘটলে উইকেটে আসেন নিম্বলকর, অপরপ্রান্তে ব্যাট করছিলেন কমল ভান্ডারকার। দ্বিতীয় দিনেও উইকেটে রাজত্ব করেন এই দুই ব্যাটসম্যান। দিনের খেলা শেষ হবার একবারে শেষ মুহূর্তে পুরুষোত্তমের বলে ২০৫ রানের ইনিংস খেলে আউট হন ভান্ডারকার। মাত্র পাঁচ ঘন্টায় ৪৫৫ রান করেন নিম্বলকার- ভান্ডারকার জুটি।

ভান্ডারকারের পতনের পর উইকেটে আসেন শরদ দেওধর(কিংবদন্তি ডিবি দেওধরের ছেলে), দিনশেষে মহারাষ্ট্রের সংগ্রহ দাঁড়ায় দুই উইকেট হারিয়ে ৫৮৭রান। উইকেটে তখন নিম্বলকর অপরাজিত ৩০১ রানে। রানের এই ধারা অব্যাহত থাকে তৃতীয় দিনেও। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ২৪২ রান যোগ করেন নিম্বলকর আর দেওধর।

দেওধর ৯২ রান করে আউট হলে ভাঙে এই জুটি। এরপর উইকেটে এসে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি মোহনলালও। মহারাষ্ট্রের সংগ্রহ তখন দাঁড়ায় চার উইকেটে ৮০১। অপরপ্রান্তে তখনো অবিচল নিম্বলকার। নির্বিকারচিত্তে ব্যাট করে যাচ্ছেন এমনভাবে যেন ব্যাট করাই দুনিয়ার সহজতম কাজ। চারশ রান ছাড়ালেন ভালোভাবেই, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্র্যাডম্যানের করা ৪৫২ রানের রেকর্ড তখন হুমকির মুখে।

চা পানের বিরতির সময় মহারাষ্ট্রের সংগ্রহ দাঁড়ায় চার উইকেটে ৮২৬ এবং নিম্বলকর অপরাজিত ৪৪৩ রানে। ম্যাচের তখনো এক বাকি সেশন এবং পুরো এক দিন। মহারাষ্ট্রের সামনে তখন ইনিংস ব্যবধানে জয় ছাড়াও আরো কয়েকটি রেকর্ড হাতছানি দিচ্ছে। ডনকে অতিক্রম করতে নিম্বলকরের তখন প্রয়োজন কেবল দশটি রান এবং মহারাষ্ট্রের সামনে সুযোগ চারবছর আগে হোলকারের করা ৯১২ রানের দলীয় সংগ্রহ টপকে যাবার।

কাঠিওয়ারের অধিনায়ক রাজপুত্র, ঠাকুর সাহেব অব রাজকোট, যিনি কিনা আগের ম্যাচেই করেছেন ৭৭ রান; যদিও পুরো ক্যারিয়ারে কেবলমাত্র দুটি ফিফটিই করতে পেরেছিলেন। সকল খেলোয়াড়ের চা পান করছিলেন এমন সময় হুট করে ঠাকুর সাহেবের জাত্যাভিমান জাগ্রত হয়। লজ্জার রেকর্ডে তার দলের নাম থাকবে এই অজুহাতে তিনি দল নিয়ে মাঠে নামতে অস্বাকৃতি জানান। মহারাষ্ট্রের অধিনায়ক রাজা গোখলেকে বলেন হয় তারা ইনিংস ডিক্লেয়ার ঘোষণা করবে নয়তো তিনি আর দল ম্যাচ খেলতে নামবেন নাহ। ম্যাচ অফিশিয়াল এবং গোখলে কাঠিওয়ারকে অনুরোধ করেন দুই ওভার বল করতে যেন নিম্বলকার ডনকে টপকে যেতে পারেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা ঠাকুর সাহেব তার দলকে নিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যান।

‘তারা বলতে থাকে তুমি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট রান করে ফেলেছো। তাদের অধিনায়ক ভেবেছিল এই ইতিহাস রেকর্ডবুকে লেখা থাকলে সেটা কাঠিওয়ারের জন্য অসম্মানজনক। তারা নূন্যতম খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখায়নি। আমি বিশ্বরেকর্ডটি নিজের করে নিতে মরিয়া ছিলাম’, পরবর্তীতে জানান নিম্বলকার।

‘ডন নিজে টেলিগ্রামের সাহায্যে তাদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের অনুরোধ জানান যেন আমাকে ব্যাট করার সুযোগ দেয়। কিন্তু তারা চা বিরতির পর আর মাঠে নামেননি। তারা বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে রেলস্টেশনে চলে যান।’

নিম্বলকার ৮ ঘন্টা ১৪ মিনিট ধরে ব্যাট করেন এবং ৪৬টি চার এবং একটি ছক্কার সাহায্যে ৪৪৩ রান করে অপরাজিত থাকেন। ডন এর রেকর্ডটি শেষ পর্যন্ত দশ বছর পরে হানিফ মোহাম্মদ ভাঙেন যিনি প্রতিপক্ষ দলের দ্বারা এরকম উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি এবং রান আউট হওয়ার আগে ৪৯৯ রান করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে, ব্রায়ান লারা ডারহামের বিপক্ষে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ৫০১ রান করে রেকর্ডবুকে নিজের নাম খোদাই করেন।

তবে নিম্বলকরের ৪৪৩ রেকর্ড এখনও কোনও ভারতীয়ের পক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস এবং শীর্ষ সারির ক্রিকেটে চতুর্থ সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link