১৮৭৭ সালে ইতিহাসের প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। তবে ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডেতে কোন সেঞ্চুরি হয় নি; হয়েছিল দ্বিতীয় ম্যাচে। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ডানহাতি ওপেনার ডেনিস অ্যামিস।
সেই ১৯৭২ সালে ইতিহাসের ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে অভিষেকে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ডেনিস অ্যামিস। তিনি করেছিলেন ১০৩ রান, ১৩৪ বলে। পরবর্তীতে আরও ১৪ জন ক্রিকেটার ওয়ানডে অভিষেকে সেঞ্চুরি পেলেও আর কোন ‘ইংরেজ’ এটা করে দেখাতে পারেন নি। এমনকি, ক্লিথ ফ্লেচারের সাথে যুগ্মভাবে ওয়ানডের প্রথম শতরানের জুটির (১২৫) অংশীদারও ডেনিস অ্যামিস।
কেবল অভিষেকেই নয়, অ্যামিস সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও। ১৯৭৭ সালে কেনিংটন ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ‘বিদায়ী’ ওয়ানডেতে খেলেন ১৪৬ বলে ১১৮ রানের চমৎকার একটি ইনিংস।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ‘অভিষেক’ ও ‘বিদায়ী’ উভয় ম্যাচেই সেঞ্চুরি করার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মাত্র দুজন; ইংল্যান্ডের ডেনিস অ্যামিস আর উইন্ডিজের ডেসমন্ড হেইন্স।
ওয়ানডের মত বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানও ডেনিস অ্যামিস। ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। ১৪৭ বলে ১৩৭ রানের ইনিংসটির হাইলাইটস ছিল ১৮টি চারের মার। যার সুবাদে ৬০ ওভারে ৩৩৫ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছিল ইংলিশরা।
অনেকের চোখে তিনি ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ওপেনারদের একজন। টেকনিক্যালি কারেক্ট, ক্ল্যাসিকাল ঘরানার এই ওপেনার ফাস্ট বোলিংটা নাকি দারুণ খেলতেন। কাভার ড্রাইভ ও ফ্লিকে পারদর্শী অ্যামিসের প্রধান দুটো স্কোরিং এরিয়া ছিল এক্সট্রা কভার ও মিড উইকেট।
ডেনিস অ্যামিসের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল রক সলিড টেম্পারমেন্ট এবং লম্বা ইনিংস খেলার সক্ষমতা। একবার সেট হয়ে গেলে তাঁকে আউট করা খুব কঠিন ছিল। কথিত আছে, কোনমতে চল্লিশ পেরোলে নাকি তাঁকে আর আউটই করা যেত না!
ওয়ানডের কিংবদন্তি অ্যামিস সফলতা পেয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটেও। বেশি না, একটু আলাদাভাবে বলতে চাই দুটো ইনিংসের কথা।
১৯৭৪ সালে জ্যামাইকা টেস্টে অ্যামিস খেলেছিলেন ৫৬৩ বলে ২৬২ রানের হার না মানা এক ইনিংস। যার কল্যাণে প্রায় হারতে বসা ম্যাচটা বাঁচাতে সমর্থ হয়েছিল ইংলিশরা। তাঁর ইনিংসটির মাহাত্ম্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যখন শুনবেন ওই ম্যাচে দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর ছিল মাত্র ৩৮!
১৯৭৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টে দলের পরাজয় এড়াতে ব্যর্থ হলেও দুর্ধর্ষ পেস ব্যাটারির বিপক্ষে অ্যামিস যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, সেটিকে খুব হাইলি রেট করা হয়। অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েইন ড্যানিয়েল, ভ্যানবার্ন হোল্ডার আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের মত গতিদানবকে শক্ত হাতে তিনি যেভাবে সামলেছিলেন, তা ছিল বলার বাইরে।
সে ম্যাচে ‘হুইস্পারিং ডেথ’ খ্যাত মাইকেল হোল্ডিং একাই নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট। অ্যামিসের ৪৩৫ বলে ২০৩ রানের ‘কালজয়ী’ ইনিংসটিকে বলা যায় ক্লাস, কম্পোজার, স্কিল, টেম্পারমেন্ট ও মানসিক দৃঢ়তার চূড়ান্ত প্রদর্শনী।
হোল্ডিংয়ের মত ফাস্ট বোলারকে খেলার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘Holding’s bowling at The Oval was so quick that being hit on the pads produced pain so incredible that I thought I had been shot.’
৫০ টেস্টের ক্যারিয়ারে মোট ১১ বার সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ডেনিস অ্যামিস, যার মধ্যে ৮ বারই (৭২ শতাংশ) তিনি পেরিয়েছেন দেড়শ রানের কোটা। শতকরা হারে সবচেয়ে বেশিবার শতরানকে দেড়শ’ বা তার বেশি রানের ইনিংসে রূপদানকারী ব্যাটসম্যান তিনিই।
অ্যামিসের ঠিক পরেই আছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ক্যারিয়ারের ২৯টি সেঞ্চুরির ১৮টিই (৬২ শতাংশ) দেড়শ ছাড়ানো অর্থাৎ তিন অঙ্ক ছোঁয়ার পর ৬২ শতাংশ ক্ষেত্রেই অন্তত আরও ৫০টা বেশি রান করতেন সর্বকালের সেরা এই ব্যাটসম্যান।
অ্যামিসের ফার্স্ট ক্লাস গড় ৪৫, টেস্ট গড় ৪৬ আর ওয়ানডে গড় ৪৭। তবে অনেকের মতে তিনি তাঁর গড়ের চেয়েও ভাল ব্যাটসম্যান ছিলেন।
১৯৪৩ সালের ৭ এপ্রিল, আজকের এই দিনে বার্মিংহামের ওয়ারউইকশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন ক্রিকেটের এই জীবন্ত কিংবদন্তি। অ্যামিস ছিলেন ওয়ারউইকশায়ারের ঘরের ছেলে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত টানা ২৭ বছর খেলেছেন একই ক্লাবের হয়ে। এই ক্লাবের হয়েই তাঁর রয়েছে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৪০ হাজারের বেশি রান এবং ১০০ টির বেশি সেঞ্চুরি।
শেষ করব একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। সত্তরের দশকে ক্রিকেটে সর্বপ্রথম হেলমেটের ব্যবহার প্রচলিত হয়। এই ধারা প্রচলনের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা যায় ডেনিস অ্যামিসকে।
ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম হেলমেট অবশ্য কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে না, দেখা গিয়েছিল ক্যারি প্যাকারের বাণিজ্যিক টুর্নামেন্ট ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের সৌজন্যে। ১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজের প্রথম মৌসুমে অ্যান্ডি রবার্টসের বাউন্সারে চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ডেভিড হুকসের। এই ঘটনার পরই নিজের মাথা বাঁচাতে হেলমেট পরে ব্যাট করতে নামেন অ্যামিস। তবে সেটা ছিল মোটর বাইকের হেলমেট। সেই হেলমেটে কোন গ্রিল ছিল না।