বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক আলিসন মিশেল একবার একটা তালিকা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। আশির দশক অবধি কোন কোন ব্যাটসম্যানের বাইশগজে পা রাখার দৃশ্যটুকু দেখার জন্যেই দর্শক উত্তাল হয়ে যেতে পারে সেই সব মহারথীদের।
স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের কথা মাথায় রেখেও একনম্বরে দীর্ঘদেহী ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের নাম লেখার পর আর একটাই জায়গা বেঁচে ছিল সেই ছোট্ট তালিকায়। যে জায়গা দিয়ে লেজি আরোগ্যান্স নিয়ে চিকলেট চিবোতে চিবোতে নেমে পড়েছিলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস!
ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে হেলমেট বাধ্যতামূলক না, ক্যারিবিয়ান ঔদ্ধত্যে চিকলেটটা মাস্ট- বলতে বলতে হাসছিলেন আলিসন
১৯৭৪-৭৫ সাল নাগাদ ডেনিস লিলি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের পোস্টার বয়। অজি মিডিয়া লিলিকে সামনে রেখে একটা মাইন্ড গেম খেলে ফেলত বাকি দেশগুলোর সাথে। আর তার সাথে গ্রেগ চ্যাপেলের ধুরন্ধর মস্তিষ্ক। তবে লিলি যদি চক্রব্যুহের কারিগর হন তবে সেই ব্যুহের ভেতর শ্বাসবায়ু শুষে নেওয়া যন্ত্রেরনাম জেফ থমসন৷ লিলি-থমসন জুটি সম্পর্কে অজি মিডিয়ায় একটা কথা বেশ প্রচলিত ছিল, ‘আগে বল দেখতে পেলে, তারপর তো ছোঁয়ানো!’
১৯৭৪-৭৫ অ্যাশেজের পর অস্ট্রেলিয়ার জীবন্ত স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে লিলি ২৫ উইকেট, থমসন ৩৩ উইকেট। মাইক ডেনিসের ইংল্যান্ডের এই গতিদানবের দৌরাত্মে এমন হাল যে ইনজুরির জন্য দেশ থেকে প্লেয়ার আনানোর কথাও শুরু হয়ে গেল। তবে ইংল্যান্ড কোনোমতে বেঁচে ফেরার পরেই সে দেশে পাড়ি জমানোর কথা লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ভিভ তখন সদ্য ডেবিউ সেরেছেন টেস্টে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম দুই ইনিংসে ৭ রান।
ব্যাঙ্গালোরের ঘুর্ণি পিচে খুব একটা সুবিধা না করতে পারলেও দিল্লীতে নিজের তৃতীয় টেস্ট ইনিংসেই হাঁকিয়েছেন ১৯২ রানের একখানা পেল্লাই ইনিংস। এহেন ভিভ যখন ব্রিসবেন পৌঁছালেন তখন গাব্বার উইকেটের পাশে নিজের পুরু গোঁফে তা দিচ্ছেন লিলি। প্রথম টেস্টে ভিভ যখন মাঠে নামছেন তখন অজি সমর্থকদের টিপ্পনির মুখে ভিভ। একবার টুপির তলায় শান্ত দুটো চোখ দিয়ে দেখলেন গাব্বার গ্যালারিকে। শান্ত ভাবে নেমে স্টান্স নিতেই সামনে লিলি। এক নবাগত তরুণকে লিলি সুযোগ দিলেন মাত্র তিনটে বল। শূণ্য রানে আউট ভিভ।
সিরিজটা ভালো গেল না। তবে পঞ্চম টেস্ট থেকে ভিভ নিজেকে তাঁর প্রিয় তিন নম্বর পজিশনে তুলে আনলেন।
অস্ট্রেলিয়া বুঝতেও পারেনি ভিভ নিঃশব্দে নিজেকে তৈরী করছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে একটা সেঞ্চুরি এল। তবে ওটুকুই। স্কোরবোর্ড খুব বেশি কিছু না বললেও আধুনিক ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ কোষ্ঠিপাথরের ওপর ইতিহাস লেখার ছেনি হাতুড়ি চলতে শুরু করেছিল এডিলেডের ওই ইনিংস থেকেই। এবং তিন নম্বর পজিশন? যেখানে ভিভ রিচার্ডসের সামনে এভারেজে এতদিনের ইতিহাসে রয়েছেন মাত্র দুজন ওয়ালি হ্যামন্ড ও ডন ব্র্যাডম্যান।
ডেনিস লিলির হুংকারটা মাথায় গেঁথে রইল ভিভের। সাথে লিলির বলে উইকেট ছুঁড়ে আসার অপমান। বদলার মাটি শক্ত করতে সামনে ইংল্যান্ড সিরিজ। ভিভের কেরিয়ারের চড়াই উত্থান গ্রাফ শুরু হল ইংল্যান্ড সফর থেকে, এক সিরিজে এক টেস্ট কম খেলে ৮২৯ রান, সেই বছরে ভিভ করলেন ১৭০০-র ও বেশি রান। তবে লিলির অপমানের বদলাটা শত সাফল্যেও মুছে যায়নি ভিভের মাথা থেকে। ১৯৭৯-র অজি সফরে যখন ভিভ গেলেন তখন মিডিয়ায় ভিভের ব্যাটিং সম্পর্কে লেখা হল- ‘গ্রেগের মতো বোলারকে অসহায় করে দেবার ক্ষমতা, গাভাস্কার আর আব্বাসের মতো টাইমিং- এই দুই-এর যোগফলের সাথে মিলে যায় ভিভের শান্ত ব্যাটিং’ – সত্যিই কি শান্ত?
৭৯-তে ভিভ মাঠে নামতেই পরপর বাউন্সার শুরু করলেন ডেনিস লিলি। লিলি জানতেন ভিভের আসল দূর্বল জায়গা তাঁর ইনিংসের শুরুর কয়েকটা ওভার। দৈত্যাকার ভিভ ঐ সময়টুকু নেন নিজের অনুমানক্ষমতাকে তৈরী করে নিতে। ধুরন্ধর লিলি ভিভের মাথা লক্ষ্য করে লাগাতার বাউন্সার ফেলে চলেছেন। তবে এবার আর ভাঙলেন না ভিভ। লিলির সমস্ত গোলার সামনে যেন অগ্নীশ্বর হয়ে উঠল ভিভের ব্যাট।
অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পেস বোলিং জুটি থমসন-লিলি আর ব্রিসবেনের সেই সবুজ গালিচায় লিলিকে দাঁড় করিয়ে তিনবছর আগের সেই অপমানের বদলা সুদে আসলে তুললেন ভিভ। স্কোরবোর্ড লিখে রাখল ২০ টা সপাটে বাউন্ডারির হিসেব। ডেনিস লিলি রাগে ছুঁড়ে দিলেন সোয়েটার। তবে হাল ছাড়লেন না লিলি। ১৪০ রানের দুরন্ত ইনিংসটার শেষ পাতা লেখার কারিগরও যে তিনিই। ভিভের বারুদ শেষ হল লিলির হাতেই। তবে ততক্ষণে বদলা নেওয়া হয়ে গেছে তাঁর।
বডিলাইনের আগুনে হেরল্ড লারউডের ব্রহ্মাস্ত্রের সামনে যদি ভীষ্মের মতো দাঁড়ান ডন ব্র্যাডম্যান তবে সত্তর-আশির দশকে ডেনিস লিলির গোলার সামনে নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিখাদ করেছিলেন ভিভ। বদলা-পাল্টা বদলায় এই গোলা-বারুদের ইতিহাসই ছিল ক্রিকেট রোম্যান্টিসিজমের সবচেয়ে জমকালো অধ্যায়। ইতিহাস বলছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিভের ব্যাটিং গড় ৪৪.৪৩ কিন্তু যখনই সামনে ডেনিস লিলি এসেছেন সেই গড় পৌঁছেছে ৬১-তে!
অন্যদিকে ১১ বার লিলির লালবলের সামনে পড়েছেন ভিভ, তার মধ্যে ৮ বারই ভিভের নিধন করেছেন লিলি। সময়ের স্রোত বয়ে গেছে তার নিজস্ব নিয়মে। বহুবছর পরও যখন আন্টিগুয়ায় বসে ভিভ ইতিহাসের পাতা উল্টান, যখন লিলিকে হুক শটে উড়িয়ে দেবার আলো চলকে ওঠে তাঁর শক্ত চোয়ালে তখনই হেসে ওঠেন লিলি, মনে করিয়ে দেন – ‘তুমি ভিভ হতে পারো তবে তোমারও স্টাম্প ছিটকানোর ইতিহাস লিখেছি আমি’- ওয়াকার বিষ্ময় লিলি আর অ্যান্টিগার যুবরাজ ভিভ- দুই ক্রিকেটীয় মহারথী মুখোমুখি হলেও ক্রিকেট পৌঁছে যেত অন্যমাত্রায়, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনে হাত সেঁকত সত্তর-আশির দশকের ক্রিকেট বিশ্ব।
ভিভ বলতেন আমার ব্যাটই আমার তলোয়ার।
পার্থে ডেনিস লিলি বলের ওপর আঙুল শক্ত করছেন, নিজের লম্বা চুল থেকে চুইঁয়ে পড়া কপালের ঘাম দিয়ে শানিয়ে নিচ্ছেন নিজের গোলা, অন্যদিকে হিংস্র অজি সাম্রাজ্যের চক্রব্যুহে নিজের নিটোল পেশির শান্ত আভিজাত্য নিয়ে ভীষ্মের মতো অস্ত্র হাতে প্রবেশ করছেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস-ক্রিকেট রোম্যান্টিসিজমের পাতায় কুরুক্ষেত্রের এর চেয়ে বাস্তবিক চিত্রনাট্য আর কী-ই বা হতে পারত?