বোল্যান্ড, দ্য রোল মডেল

বক্সিং ডে নিয়ে বেশ একটা সোরগোল পড়ে যায় পুরো বিশ্ব জুড়েই। এই দিনটায় নানানধরণের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। একটা উৎসবের সৃষ্টি হয় পুরো পৃথিবীতেই। তবে এবারের বক্সিং ডে এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণটা ছিলো বোধহয় মেলবর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের মধ্যকার অ্যাশেজ সিরিজ। উত্তেজনার পারদ একেবারে আকাশচুম্বী করে মাত্র তিন দিনেই শেষ অ্যাশেজ সিরিজের তৃতীয় টেস্ট।

এই বক্সিং ডে-কে ঘিরে নানান ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ক্যালেন্ডার ঠিক এমন করেই সাজানো হয় যেন এই দিনে তারা একটি টেস্ট শুরু করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড এই রীতি মেনে চলেছে।

বক্সিং ডে টেস্টে নতুনত্ব আনবার প্রচেষ্টা ছিলো বেশ আগে থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এলো নতুন এক সম্মাননার। বক্সিং ডে টেস্টের সেরা খেলোয়াড়কে দেওয়া হবে একটি অ্যাওয়ার্ড, যার নামকরণ করা হয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের একেবারে শুরুর দিকের আদিবাসী ক্রিকেটার জনি মুলাঘের নামে।

গেলো বছরই এই ‘জনি মুলাঘ’ অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু প্রথমদফাতেই সেই অ্যাওয়ার্ড বাগিয়ে নেয় ভারতীয় খেলোয়াড় আজিঙ্কা রাহানে। কেমন যেন এক অপূর্নতা! কিন্তু এই জনি মুলাঘ অ্যাওয়ার্ডের সকল অপূর্ণতা যেন ঘুচে গেলো এক বছর বাদেই।

কেননা এবারের অ্যাওয়ার্ডটা বাগিয়ে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার স্কট বোল্যান্ড। তার থেকেও বড় বিষয় বোল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে সংযুক্ত হওয়া চতুর্থ আদিবাসী খেলোয়াড় এবং দ্বিতীয় পুরুষ খেলোয়াড়। কি দারুণ এক পারফর্মেন্স উপহার দিলেন বোল্যান্ড! কি অসাধারণ!

বছরখানেক বাদে এসে জনি মুলাঘ অ্যাওয়ার্ড পেলো পূর্ণতা। মুলাঘ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের প্রথম আদিবাসী খেলোয়াড় যিনি কিনা তাঁর পারফর্মেন্স দিয়ে ইতিহাসের অংশ হিসেবে রয়েছেন চির অমলিন হয়ে। ১৮৬৮ সনে ইংল্যান্ডে সিরিজ খেলতে যাওয়া প্রথম অস্ট্রেলিয়ান দলের উজ্জ্বল তারকা ছিলেন মুলাঘ। তিনি দশ গড়ে ২৪৫ উইকেট শিকার করেছিলেন যদিও আফসোস সেই ম্যাচগুলো প্রথম শ্রেণি কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মর্যাদা পায়নি।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বৈষম্যের কোন স্থান নেই সেই মতধারাকে আরো স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলার তাগিদ থেকেই এই অ্যাওয়ার্ড চালু করা হয় বলে ধারণা করা হয়। এবার বোল্যান্ড তাঁর আগুন ঝড়ানো বোলিং দিয়ে দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এই অ্যাওয়ার্ডটি নিজের করে নিলেন।

মাত্র চারটি ওভার বল করেছেন বোল্যান্ড। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস একেবারে একাই গুড়িয়ে দেন বোল্যান্ড। দুই দলের প্রথম ইনিংস দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো যে ম্যাচটি দ্রুতই শেষ হতে চলেছে। কিন্তু বোল্যান্ডের যেন ছিলো প্রচন্ড তাড়া। প্রথম ওভারে নিয়েছিলেন মেইডেন। এরপর যেন ঐশ্বরিক কোন শক্তি এসে ভর করলো তাঁর উপর। একেরপর এক উইকেট তুলে নিতে শুরু করেন তিনি। অবশ্য শুরুটা করে দিয়েছিলেন মিচেল স্টার্ক।

বোল্যান্ডের প্রথম উইকেট ছিলেন হাসিব হামিদ আর শেষ উইকেট ওলি রবিনসন। ইংল্যান্ডে শেষের উইকেটটা নিয়েছিলেন ক্যামেরুন গ্রিন। তা না হলে হয়ত অসাধারণ এক পরিসংখ্যান নিয়ে ম্যাচটা শেষ করতে পারতেন বোল্যান্ড। কেননা তখন তাঁর ম্যাচের বোলিং ফিগার থাকতো খানিকটা এরকম ৪-১-৭-৭। অর্থাৎ মাত্র চার ওভারে সাত রান খরচায় সাত উইকেট। নিজের অভিষেকে এমন অভাবনীয় পারফর্ম করবেন তা হয়ত তিনি নিজেও কল্পনা করেননি।

লাইল লেন্থ সুইং সবকিছুই যেন ছিলো অসাধারণ, দূর্দান্ত। একজন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তীরন্দাজের করা নিশানার মতো। সোজা বাংলায় ক্রিকেট সমর্থকদের চোখের তৃপ্তি দেওয়া বোলিং স্পেল। নিজের নেওয়া ছয়টি উইকেটের দুইটিতে প্রতিপক্ষে ব্যাটারকে পুরোপুরি পরাস্ত করে উপড়ে ফেলেছেন স্ট্যাম্প।

বেন স্টোকসকেও তিনি সেভাবেই আউট করেছিলেন। বাকিসব উইকেটেও তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং যেন ছিলো স্পষ্ট প্রতীয়মান। সুইং আর লেন্থ সাথে গতিতে পরাস্ত করে সতীর্থদেরকে স্লিপ পজিশনে ক্যাচিং অনুশীলন করিয়েছেন বোল্যান্ড। নিজেও ধরেছেন একটি ক্যাচ নিজের বলেই।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ক্রিকেটাররাও যে পিছিয়ে নেই, তারাও যেকোন সময় জাতীয় দলে এসে পারফর্ম করতে পারেন তাঁর প্রমাণ আবারো রেখে গেলেন স্কট বোল্যান্ড। বৈষম্য ঘুচে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে আদিবাসী ক্রিকেটারদের পথ আরো মসৃণ করার কাজটা করলেন বোল্যান্ড। তিনি হয়ত চাইবেন নিজের এই পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী জনগোষ্ঠির রোল মডেলে পরিণত হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link