মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেন, ‘দ্য ওয়ে আই প্লে ক্রিকেট ইজ হাউ দে প্লে ক্রিকেট।’
তিনি যেভাবে ক্রিকেট খেলেন, যেভাবে শট মারেন, তা দেখে আমারও মনে হয়, আরে এভাবে তো আমিও কত বল পিটিয়েছি অলিতে গলিতে। ধোনির সহজ সরল ক্রিকেটের সঙ্গে মিল খুঁজে পায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ।
ধোনিকে দেখে গোটা দেশ মনে করে, খেলার মাঠে ও আমার প্রতিনিধি। ও তো আমার মতোই খেলে। ধোনি মনের অনেক কাছের একজন মানুষ। ধোনির জন্য জয়ধ্বনি এখনও ওঠে স্টেডিয়ামে, গ্যালারিতে। ধোনির খেলা দেখতে দেখতে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলে উঠতেন, ‘ওর কপাল খুব চওড়া। ধোনির সঙ্গে আমিও খেলেছি।’
এক সিনিয়র সাংবাদিক একদিন হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি দেখছি বড্ড ধোনি ভক্ত হয়েছো!” ধোনি সম্পর্কে দু-একটা কথা বলায় তিনি ভেবেছিলেন, আমি বোধহয় সৌরভ বিরোধী।
২০১১ সালের ফাইনালের সেই রাত ভোলার নয়। ওয়াংখেড়ে উত্তাল। আমির খান গ্যালারি থেকে জাতীয় পতাকা আন্দোলিত করছেন। গোটা স্টেডিয়াম গাইছে বন্দে মাতরম। ঠিক যেমন মেক্সিকান ওয়েভ ওঠে গ্যালারিতে। ঠিক তেমনই বন্দে মাতরম ঢেউয়ের আকারে ছড়িয়ে পড়ছিল ওয়াংখেড়েতে। পঞ্চাশ-ষাট হাজার মানুষ গান গাইছেন। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে থেকে দেশের রাজধানী হয়ে কলকাতায় সুরধ্বনি আছড়ে পড়ছিল।
আনন্দনগরী থেকে সেই সুরের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল আসাম, মিজোরাম, কেরল, তামিলনাড়ুতে। ধোনি বলছেন, জেতার খানিক আগে সেই বন্দেমাতরম ধ্বনির অনুরণন তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। ক্রিজে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলেন হয়তো, দেশ তৈরি হচ্ছে বিশ্বজয়ের জন্য।
এক যুগ আগের বিশ্বকাপের সময়ে একটা অদ্ভুত কথা শুনেছিলাম। শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন। ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামীতে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ টাই হয়েছিল। সচিন বলছিলেন,”খেলার শেষে আমরা ড্রেসিং রুমে ঢুকে যে যার মোবাইল দেখছিলাম। তখন সবাই লক্ষ্য করেছিলাম, একটা মেসেজ ছড়িয়ে পড়েছে মোবাইলে মোবাইলে। ধোনির নেতৃত্বে যে টুর্নামেন্টে ভারতের ম্যাচ টাই হয়েছে, সেই টুর্নামেন্টই জিতেছে ভারত।
এ তো নেহাতই সংস্কারের কথা। ভারত সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ঠিকই।
ধোনি নিজেও কি সংস্কারাচ্ছন্ন? তিনি বলে থাকেন, আমার হাতে অনেক অপশন থাকলে সুবিধা। যখন অপশন কম, তখন আমি সব গুলিয়ে ফেলি। সব ক্রিকেটারদের জীবনেই কিছু না কিছু সংস্কার থাকে। ধোনিও ব্যতিক্রম নন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ”আমি প্রথম প্রথম মাঠে ঢোকার আগে বাঁ-পা বাড়িয়ে দিতাম। কয়েকদিন বাদে মাঠে নামার আগে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। ভুলে গেলাম কোন পা আগে রেখেছিলাম?” ধোনি একটা সময় লাগাতার টস হারতেন। টসের সময়েও মনে হয় ভুলে যেতেন আগের ম্যাচে কী বলেছিলেন–হেড না টেল?
আমার ছো্ট্ট মেয়ের কথাবার্তা এখনও স্পষ্ট নয়। ধোনির ছবি দেখলে বলে ওঠে, ‘ধুনি।’
ধোনির মেয়ে জিভা। অর্থ আলো। ধোনি বলেন, ‘জিভা আমার জীবনের আলো’’ মেয়ের জন্মের সময়ে ধোনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া সফর। তার পরে বিশ্বকাপ। ধোনির স্ত্রী সাক্ষী নাকি এর জন্য এখনও ধোনিকে শাপশাপান্ত করেন। বলেন, ‘মেয়ে বড় হলে বলে দেব, তুমি মেয়ের জন্মের সময়ে কাছে ছিলে না।’
বিশ্বকাপ থেকে ফিরে মেয়েকে কোলে নিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের। মেয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করছিল মুখ দিয়ে। হাসছিল। ধোনি বোঝেননি কেন দেড়-দু’মাসের জিভা তার বাবাকে দেখে ওরকম করছে। মেয়ে নাকি এখন বলে, ‘পাপা মানে মানি’। ধোনি বলে, ‘ওকে এটা কে শিখিয়েছে জানি না।’
বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক এমএম কায়সার ভাই তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, ‘মাত্র ১৬ শব্দে লিখে ধোনি জানিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত। ঠিক ১৬ শব্দে কেন? ক্যারিয়ার যোগফল জানাচ্ছে, ধোনির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের বয়সও যে ঠিক ১৬ বছর।’
মুকেশের গান ‘ম্যায় পাল দো পাল কা শায়ের হুঁ’ ধোনির খুব প্রিয়। ধোনি নিজেও বলেন, ‘আমি তো এক বা দুই মুহূর্তের কবি। আমার গল্প ক্ষণিকের।’ কাল নতুন কেউ আসবেন, তাঁর কথাই সবাই বলবেন। ভুলে যাবেন এই কবিকে। ধোনিকে কি কেউ ভুলবেন? এই প্রশ্ন গোটা ক্রিকেট সমাজের।
হরভজন সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সবাই বলেন, মাহি মিস্টার কুল। মাঠের ভিতরে ও মিস্টার কুল ঠিকই। কিন্তু ড্রেসিং রুমের ভিতরে ও অন্যরকম।’
ভাজ্জি দেখাচ্ছিলেন,ড্রেসিং রুমে খেলা দেখার সময় ধোনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। টেনশন তাঁরও হয়। হতাশা তাঁকেও গ্রাস করে। কিন্তু এগুলো কখনোই গঠনমূলক নয়।
মোহিত শর্মা একবার একটা গল্প বলেছিলেন। সেই গল্পে রাগী ধোনির কথা বলেছিলেন মোহিত। বল করতে উদ্যত মোহিতকে থামিয়ে অন্য কারও হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন ধোনি। আর যা চাহনি দিয়েছিলেন তাতে পিলে চমকে গিয়েছিল মোহিতের। পরের দিন মোহিত যখন ধোনির কাছে যান, তখন মাহি বলেন, ‘আমি সব ভুলে গিয়েছি।’
ধোনির এক বন্ধু বলছিলেন, আগে বিস্কিট, কোল্ড ড্রিঙ্কস পছন্দ করত। চিকেন, পনিরের সঙ্গে রুটি খেয়ে নিত। কিন্তু সবজি খেত না।
ধোনির দাদা নরেন্দ্র একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘মাহি আমার থেকে ১০ বছরের ছোট ও ভাল করে ব্যাট ধরার আগেই তো আমাকে রাঁচী ছাড়তে হয়েছিল। পরে আমি যখন ফিরে আসি তখন ও দেশের হয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। আর আমাকে না চেনার কথা বলছেন? ভালই তো। বিভিন্ন শহরে মন খুলে আমি ঘুরতে পারি। কয়েক বছর আগেই ভাইচুং ভুটিয়ার র্যালিতে গিয়েছিলাম কলকাতায়। দুই সপ্তাহ থেকেছিলাম। আমাকে কেউ চিনতেই পারেনি। আর চিনবেই বা কেন? খুব ভাল করে দেখলে হয়তো বোঝা যাবে মাহির সঙ্গে মুখের মিল রয়েছে। ব্যস ওইটুকুই।’
সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ে বারবার নরেন্দ্র বলছিলেন, ‘মাত লিখো, তুম ফাঁস যাওগে।’
দীর্ঘ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কত ভক্তের সঙ্গেই তো দেখা হয়েছে ধোনির। বাংলাদেশ সফরের আগে ইডেনের সামনে শিউলি নামের এক মহিলা ভক্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ধোনির বুকে। ধোনি এখনও ভোলেননি সেই দিনের কথা। শিউলি কী করেন এখন? আজও কি তিনি ধোনি-ভক্ত? ঠিক যেমনটা আগে ছিলেন।
হার্শা ভোগলে বলেছিলেন, ‘এতগুলো বছরে মাত্র একবার আমার সঙ্গে ধোনির সাক্ষাৎ হয়েছে। ধোনি ফোন ব্যবহার করে না। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল।’
ধোনিও বলেন, ‘পরের জীবনে ফোন নিয়ে যোগাযোগটা ভাল করে শিখে নেব।আমার কমিউনিকেশন স্কিল ভাল। তবে ফোনের মাধ্যমে স্কিলটা ভাল নয়।’
একবার মোহালিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ কভার করতে গিয়েছি। সাংবাদিক বৈঠকের ঠিক আগে সঞ্চালক বললেন, ‘প্লিজ মোবাইল ফোনগুলো সুইচ অফ করে দেবেন।’
ধোনির সামনে একগুচ্ছ রেকর্ডার। তার মধ্যে একটি মোবাইলও ছিল। সাংবাদিক বৈঠক শুরু হওয়ার ঠিক আগে ওই মোবাইলটি বেজে ওঠে। ধোনি সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ধরে বলে উঠলেন, ‘স্যরজি থোরা বিজি হ্যায় হাম।’
আগামী রবিবার ইডেনে খেলতে আসছেন ধোনি। হয়তো শেষবারের মত। দেশে-বিদেশের প্রায় সব স্টেশন থেকেই তাঁর গাড়ি শেষবারের মত ছেড়ে চলে এসেছে। বাকি শ্বশুরবাড়ির শহরের ইডেন। এবার ইডেন স্টেশন থেকেও হয়তো শেষবারের মতো ছাড়বে রাঁচি এক্সপ্রেস।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আগেই বিদায় জানিয়েছিলেন। আমরা ভাবতাম, আইপিএল তো খেলবেন। ধুরন্ধর নেতৃত্ব দেখতে পাব। আগামী বছর তিনি কি! সব ভাল জিনিসই একদিন না একদিন শেষ হয়। থেকে যায় তার রেশ।
ধোনির অপসৃয়মান ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে থেকে যাবে। থেকে যাবে তাঁর তৈরি ধোনিবাদ।