মারাকানার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যখন রেফারির বাঁশির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তখনও আপামর মানুষের টিভি পর্দায় সে বাঁশির শব্দ শোনা বাকি। যতক্ষণে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে থাকা মানুষেরা সে চৌরাসিয়ার বাঁশির শব্দ শুনলেন, ততক্ষণে লিওনেল মেসির প্রতীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে।
আলবেসিয়েস্তের জার্সিতে ১৪ বসন্ত কেটে গিয়েছে, শিরোপা আসেনি। অপেক্ষার প্রহর শেষে সূর্য উঠবেই, সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে বারবার। লিওনেল মেসিকে নিয়ে মারাকানায় যখন চলছে আনন্দ উৎসব, সাইড বেঞ্চে তখন ফাইনালের ‘হিরো’ ডি মারিয়া কান্নায় রত!
৭ বছর আগে, এই মাঠেই নিজেদের ইতিহাসের প্রথম দু:খগাঁথা লেখা হয়েছিল আর্জেন্টিনার। লিওনেল মেসি, গঞ্জালো হিগুয়েনরা সেদিন মারাকানায় কেদেছিলেন, সেদিন নিজেদের জার্সির মতন বেদনায় নীল হয়েছিলেন সকলে। মারিও গোৎজের একটা শট কেড়ে নিয়েছিলো ৪২ মিলিয়ন মানুষের স্বপ্ন।
মারাকানায় হাজার হাজার আর্জেন্টাইনের সাথে কান্নায় যোগ দিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াও। সেদিন আলেহান্দ্রো সাবেলা ট্যাক্টিস সাজিয়েছিলেন তাকে মাথায় রেখেই। হাঁটুর চোটটা টুর্নামেন্টের মাঝপথ থেকেই; তাতে করে বিন্দুমাত্র সমস্যা ছিল না। কিন্তু ম্যাচের ঘন্টাখানেক আগে এক মেইল আসে মাদ্রিদ থেকে।
রিয়াল মাদ্রিদের কথা খুবই স্পষ্ট, নিজেদের খেলোয়াড়ের সেইফটি তাদের কাছে সবার আগে। তাদের কাছে খবর আছে, চোট নিয়েই মারিয়াকে মাঠে নামানোর চেষ্টায় আর্জেন্টিনা। তা করা যাবে না, ফাইনালে তাকে মাঠে দেখা গেলেই ব্যবস্থা নিবে রিয়াল বোর্ড। সাবেলা সেদিন ছিলেন নিরুপায়।
সেমিতে খেলার জো ছিল না মারিয়ার, ফাইনালে যেই না একটু ফিরেছেন মাঠে, তাতেই আপত্তি চারিদিক থেকে। শেষ দুই ম্যাচে সাইডলাইনেও থাকতে পারেননি তিনি। ছলছল চোখে দেখেছেন ফাইনালে দলের হার। বারবার হয়তো মন চেয়েছিল, বামপাশ দিয়ে একটা আক্রমণ করে জার্মানির ডানপাশ অচল করে দিয়ে, পারেননি।
ফাইনাল ভাগ্যটা তার আজীবনই খারাপ। আজীবন বললে ভুল হবে, জাতীয় দলের জার্সিটা গায়ে চড়ালেই যেন দূর্ভাগ্য চুপি চুপি পিছু এসে দাঁড়ায় তার। ডি মারিয়া ফাইনাল খেলতে জানেন, ফাইনাল জিততেও জানেন। প্রমাণটা মারাকানার ফাইনালের দেড় মাস আগেই পাওয়া গিয়েছে।
রিয়াল মাদ্রিদের ১২ বছরের অপেক্ষা মিটিয়েছেন তিনি। না কোনো গোল করেননি, কিন্তু খেলাটা চালিয়েছেন তিনিই। বিশেষত ১১০ মিনিটে। অ্যাটলেটিকোর ডিফেন্স ভাঙ্গতে যেখানে সকলের ঘাম ছুটে যাচ্ছিল সেখানে কী অনায়াসেই জিগ-জ্যাগ করে ঢুকে পরলেন তিনি। গোলটা হয়েছে, গ্যারেথ বেল ১১০ মিনিটে প্রথমবারের মতন লিড এনে দেন রিয়াল শিবিরে। কিন্তু মাদ্রিদিস্তাদের মনে গেঁথে আছে সেই ড্রিবলিং। সেদিন লিসবনে নিজের নামের স্বার্থকতা পূরণ করেছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া!
মারিয়া পারেননি ফাইনাল জেতাতে, এক বছরেই দুই ফাইনাল জেতার আনন্দে মাতা হয়নি সেদিন তাঁর। ঠিক এক বছর পর আরেকটা ফাইনালে নাম লিখিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেমিতে প্যারাগুয়ের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তিনি একাই। পুরো টুর্নামেন্ট টপ ফর্মে থাকা লোকটা কেন আবারও সেই ফাইনালে এসেই চোটে পরবেন? ম্যাচের ২৯ মিনিটেই তাকে তুলে নিয়ে যেতে হয় মাঠ থেকে। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে এক্সট্রা টাইম শেষে পেনাল্টিতে আর্জেন্টিনার অসহায় পরাজয় দেখেছিলেন তিনি।
পরের ফাইনালটার গল্পও একেবারে একই রকম, সেবার অবশ্য টুর্নামেন্টে তেমন ফর্মে ছিলেন না। কিন্তু ফাইনালে জেরার্ডো মার্তিনোর ভরসা ছিলেন ডি মারিয়াই। এবারও পারেননি, ম্যাচের মাঝপথে নিজেই উঠে এসেছিলেন। প্রতিটি ফাইনাল, একই গল্প। ক্লাবের অ্যাঞ্জেল, জাতীয় দলের অ্যাঞ্জেল হয়ে উঠতে পারেন না। পরপর তিন বছর দেখেছে বিশ্ব, দেখেছে আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা, ক্লাবের অ্যাঞ্জেল জাতীয় দলে হয়ে যান ডেভিল।
অথচ লিওনেল মেসির মুখে, দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি গোটাতে চান অ্যাঞ্জেল। যেমনটা ফুটিয়েছিলেন ২০০৮ সালে, বেইজিংয়ে। অলিম্পিকে সে দলে ফাইনালে অ্যাঞ্জেলের মত করেই আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি।
৫৮ মিনিটে নাইজেরিয়ার জালে চিপ করে বল পাঠিয়েছিলেন ডি মারিয়া। লিওনেল মেসির জূবনে আকাশি-সাদা জার্সিতে অর্জন বলতে ওটুকুই। নিজের প্রিয় অ্যাঞ্জেলকে বড্ড প্রয়োজন তার ইউরো জিততে।
আর কেউ না বুঝলেও আরেক লিও বুঝেছিলেন। ফাইনালের প্রেশারটা এই দলে অন্য যে কারো চাইতে ডি মারিয়াই ভালো হ্যান্ডেল করতে পারেন। লিওনেল স্ক্যালোনি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে তাকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, মাত্র এক ম্যাচে রেখেছিলেন শুরু একাদশে।
জানতেন, নিজেদের লাকি অ্যাঞ্জেলকে নজরে পরতে দেওয়া যাবে না। নিজের ট্রাম্পকার্ডটা নিজের কাছেই বরাদ্দ রাখলেন ফাইনালের আগ পর্যন্ত। ফাইনালে চিরপ্রতীদ্বন্দ্বীদের সামনে পেয়ে সেই ট্রাম্পকার্ডটাই চাললেন।
ভাগ্যদেবী টাইসও হয়তো ডি মারিয়াকে নিয়ে খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, একই দূর্ভাগ্যে দূর্ভাগা আর কতদিন করা যায়? ডি মারিয়াকে এবার ছেড়েই দিলেন, আর তাকে উড়তে দিলে কী হয়, তা তো জানাই ছিল। অ্যাঞ্জেল উড়েই গেলেন। উড়ে উড়েই তৈরি করলেন ইতিহাস, যা পারেনি আগে কেউ।
২২ মিনিটের মাথায় বাড়ানো পাসটা যতটা না নিখুঁত ছিল, তার থেকে নিখুঁত ছিল তার চিপ। এক চিপে বল পৌছে দিয়েছেন জালে। বিন্দুমাত্র সুযোগ পাননি এডারসন। মুক্ত বিহঙ্গের মতন উড়তে শুরু করলেন ডি মারিয়া। তিনি জানেন, উড়ে যেতে তার আজ কোনো মানা নেই।
স্কালোনি শেষ ম্যাচেও রিস্ক নিলেন না, গোড়ালিতে সামান্য ব্যথা বারতে দেখেই তড়িঘড়ি করে তুলে আনলেন তাকে। ততদিনে অ্যাঞ্জেলের কাজ করে এসেছেন তিনি। বাকিটা সম্পন্ন করতে সতীর্থরা আর ভুল করেননি। ফাইনালটা অ্যাঞ্জেল উপহার দিতে পেরেছেন তার প্রিয় বন্ধু লিওকে।
গত তিন বছরে বেশ বড়সর ছুরির নিচ দিয়ে গিয়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবল। লিওনেল স্কালোনি ওল্ড গার্ডদের একে একে ছেঁটে ফেলেছেন, কোনোমতে সেখানে টিকে গিয়েছেন ডি মারিয়া। তাকে নিয়েও কথা উঠেছে, ক্লাবে তেমন ভালো ফর্মে থাকেন না, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ালেই ইনজুরি; এই খেলোয়াড়কে কি আর সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে? স্কালোনি রেখেছিলেন ভরসা। তার প্রতিদান দিয়েছেন ডি মারিয়া ফাইনালের অ্যাঞ্জেল হয়ে।