২০০৮ সালের অলিম্পিক ফাইনাল, ২০১৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদের বিখ্যাত লা ডেসিমা জয়, ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনাল কিংবা ২০২২ সালে ফাইনালিসমা – এই সব শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচগুলো আদতে আলাদা হলেও একটি বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছে।
একটি নামের ঔজ্জ্বল্য মিলিয়ে দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোকে। ফুটবলের পাঁড়ভক্ত মাত্রই বলে দিতে পারবে নামটি অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া; ফাইনাল ম্যাচের সমার্থকই হয়ে উঠেছে এই নাম।
আরো একটি ফাইনাল আরো একবার মাঠে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। এবারও ভক্তদের হতাশ করেননি তিনি; প্রতিবারের মত এবারও দুই ফাইনালিস্টের মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন এই তারকা। তবে অন্য যেকোনো বারের চেয়ে এবার মঞ্চ সবচেয়ে অনন্য। ফুটবলের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে নিজের ভয়ংকরতম রূপে আবির্ভূত হয়েছেন ডি মারিয়া।
ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনার মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচে নজরটা বেশি ছিল লিওনেল মেসি আর কিলিয়ান এমবাপ্পের দিকে। কিন্তু রেফারির বাঁশি বাজতেই ক্যামেরার ফোকাস নিজের দিকে নিয়ে নেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ডিফেন্ডারদের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়া, গতি আর ড্রিবলিংয়ে ফরাসিদের রক্ষণে বারবার ত্রাস সৃষ্টি করতে শুরু করেন তিনি।
তবে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া প্রথম প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন ম্যাচের ২২তম মিনিটে। নিজের মার্কারকে বোকা বানিয়ে দারুণ দক্ষতায় ডি-বক্সে ঢুকে পড়া ডি মারিয়া এরপর আদায় করে নেন পেনাল্টি। স্পট কিক থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে নিতে ভুল হয়নি সতীর্থ লিওনেল মেসির।
মিনিট দশেক পর স্কোর শিটে নিজের নাম তোলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ম্যাক অ্যালিস্টারের স্কয়ার করা বলটি যখন তাঁর পায়ে এসেছিল সামনে তখন ছিল খালি গোলপোস্ট। আলতো টোকায় বল জালে জড়িয়ে উল্লাসে মেতে উঠতে আর দেরি করেননি সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। দল যখন ২-০ গোলে এগিয়ে তখনও শান্ত হননি তিনি, একের পর এক হানা দিয়েছেন ফ্রান্সের রক্ষণে।
শুধু গোল আর অ্যাসিস্ট নয়, যতক্ষণ মাঠে ছিলেন ততক্ষণই বল পায়ে উজ্জ্বল ছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। এমনকি স্বয়ং লিওনেল মেসি ছিলেন এই উইঙ্গারের ছায়ায়। অন্তত ৪৫ মিনিট বা এর বেশি সময় খেলেছে এমন খেলোয়াড়দের মাঝে ডি মারিয়ার পাসিং ছিল সবচেয়ে নিঁখুত। একটি পেনাল্টি জেতার পাশাপাশি ৩টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন তিনি।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার ক্যারিয়ার জুড়েই ইনজুরি ছিল নিত্যসঙ্গী; ব্যতয় ঘটেনি এদিনও। ৬৪ মিনিটের সময় পায়ে আঘাত পান তিনি। ঝুঁকি না নিয়ে কোচ লিওনেল স্কালোনি সাথে সাথেই তুলে নেন এই ফুটবলারকে। তবে ম্যাচের পুরোটা সময় মাঠে না থাকার আফসোস নিশ্চিতভাবেই মুছে গিয়েছে তাঁর মন থেকে। টাইব্রেকারের পরীক্ষায় জিতে শিরোপা ঘরে তুলেছে আলবিসেলেস্তারা।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া অবশ্য এই নাটকীয় ম্যাচের একমাত্র নায়ক নন; তিনি মাঠ ছাড়ার পর ঘটেছে অনেক কিছু; রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। কিলিয়ান এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক দেখেছে, দেখেছে লিওনেল মেসির স্বভাবসুলভ জাদুকরি প্রদর্শনী।
কিন্তু, আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ এনে দেয়ার কান্ডারি হিসেবে মনে রাখতেই হবে ডি মারিয়াকে। ফাইনালে শক্তিশালী ফ্রান্সের বিপক্ষে দলকে এগিয়ে রাখার মূল কাজটা কিন্তু এই জুভেন্টাস তারকাই করেছেন।
২০১৪ সালে ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে পারেননি অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। সেই আক্ষেপ অনেকদিন বয়ে বেড়িয়েছিলেন তিনি, তবে এবার আক্ষেপ ঝরেছে আনন্দের অশ্রু হয়ে। অধরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি; ‘বিগ ম্যাচ হিরো’ ডি মারিয়া আরো একবার নিজের নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছেন।
বিশ্বকাপের ফাইনাল দিয়ে আকাশি-সাদা জার্সিটা তুলে রাখার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন, আর এবার সবচেয়ে সুন্দরতম উপায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সমাপ্তি রেখা টানলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। তবে আর্জেন্টাইন ভক্তরা কখনোই বিদায় দিতে পারবে না তাঁকে, ডি মারিয়াকে তারা বন্দী করেছে মনের মনিকোঠায়। এই ভালবাসার বন্দীত্ব আর কখনোই হয়তো ফুরোবে না ডি মারিয়ার।