৯ জুন, ১৯৮৩। বিশ্বকাপের মঞ্চে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ জিম্বাবুয়ের জন্য। তাও আবার শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে! খর্ব শক্তির নব্য উঠে আসা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া হেসে খেলেই জিতবে এমনটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতেই ১৩ রানের জয় তুলে নেয় জিম্বাবুয়ে! হ্যাঁ, শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই!
বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ‘আপসেট’ বলা চলে! কেপলার ওয়েসেলস, অ্যালান বোর্ডার, ড্যানিস লিলিদের সেদিন মাত দিয়েছিল ক্রিকেট পাড়ার নব্য এক দল। জিম্বাবুয়ের সেই ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক কে ছিলেন জানেন? – ডানকান ফ্লেচার!
নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে খেলেছেন তাও আবার অধিনায়ক হিসেবে। এমনকি সেই ম্যাচে জয়ের নায়কও ছিলেন ফ্লেচার! ব্যাট হাতে ৬৯ রানের পর বল হাতে ৪২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ন্যটিংহামে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে মাত দেন ফ্লেচার। তাঁর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে এক ঐতিহাসিক জয় পায় জিম্বাবুয়ে। নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার! এর চেয়ে ভাল অভিষেক কি হতে পারে?
১৯৬৯ সাল থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলছিলেন তিনি। জিম্বাবুয়েকে বিশ্বকাপের মঞ্চে নিতে নিজের সেরাটাই দিয়েছিলেন ফ্লেচার। এরপর আইসিসি ট্রফিতে ওয়ার্ল্ডকাপ কোয়ালিফায়ারে জিম্বাবুয়ের হয়ে নিজের সেরাটা দিয়ে ফ্লেচার দলকে টেনে নেন বিশ্ব আসরে। বারমুডার বিপক্ষে ফাইনালে ৩৪ রানে ৩ উইকেট শিকার করে জিম্বাবুয়েকে জয় এনে দেন ফ্লেচার। এরপর বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য সেই জয়।
উঠে এসেছিলেন এক স্পোর্টস ফ্যামিলি থেকেই। ভাই অ্যালান ফ্লেচার জিম্বাবুয়ের হয়ে প্রথম ক্লাস ক্রিকেটে খেলেছেন। বোন ছিলেন জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক। ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে হকিতে স্বর্ণপদকও জেতেন ফ্লেচারের বোন। এমনকি জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে সেটিই ছিল প্রথম অলিম্পিক গোল্ড! ওই হকি দলে আরেক জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটার শন উইলিয়ামসের মা-ও খেলেছিলেন।
বিশ্বকাপে খেলাকালীন ফ্লেচারের বয়স তখন ৩৫। ক্যারিয়ারের শেষের দিকেই ছিলেন তিনি। ওই টুর্নামেন্টেই ক্রিকেটকে বিদায় জানান ফ্লেচার। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য ম্যাচ কিংবা স্মৃতি যদি বলেন বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচজয়ী অলরাউন্ড পারফরম্যান্স এবং ওই টুর্নামেন্টেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস! ৬ ম্যাচের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটার শুরু এবং শেষ বিশ্বকাপের মঞ্চেই।
ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি খুব কম হলেও নাম কামিয়েছিলেন কোচ হিসেবেই। ক্যারিয়ারে মাত্র গুটিকয়েক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ফ্লেচার শূন্য থেকে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন অনেক সফলতা।
এরপর জিম্বাবুয়েতে শুরু হলো মুদ্রাস্ফীতি। ১৯৮০ সালের আগে জিম্বাবুয়ের নাম ছিল রোডেশিয়া। যা দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অংশ হিসেবে ধরা হতো। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের হাত ধরেই স্বাধীনতা পায় জিম্বাবুয়ে। এরপরই দেশে অর্থনৈতিক মন্দা সহ দূর্নীতির কারণে টাকার মান ক্রমাগত নামতে থাকে। রবার্ট মুগাবের হাতেই এক প্রকার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন জিম্বাবুয়ে। এমতাবস্থায় ফ্লেচারও ভেবে পাচ্ছিলেন না ঠিক কি করবেন। নেই চাকরি, নেই কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা – খালি হাতেই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি জমালেন দক্ষিণ আফ্রিকায়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছু সময় হতাশায় কাটলেও দ্রুতই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় ফ্লেচারের। ওয়েস্টার্ন প্রোভিন্সের হয়ে দায়িত্ব পান কোচিং করানোর! তাঁর অধীনে ওয়েস্টার্ন প্রোভিন্স জয় পায় ‘কুরি কাপ’। এরপর কাউন্টি দল গ্ল্যামরগানের হয়ে কোচিং করানোর সুযোগ পান তিনি। তাঁর অধীনে প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন হয় গ্ল্যামরগান! এমনকি ২৮ বছরে প্রথমবার ওই ক্লাব শিরোপা জেতে ফ্লেচারের হাত ধরে। ধীরে ধীরে কোচিংয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি নিজের প্রোফাইলটাও বেশ ভারী করছিলেন ফ্লেচার।
সেখান থেকে পেলেন আরও বড় দায়িত্ব। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রথম পর্বেই বাদ পড়ে ইংল্যান্ড। তৎকালীন কোচ ডেভিড লয়েডকে বাদ দিয়ে নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ফ্লেচারকে! কোনো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কোচিং করানোর দায়িত্ব পান ফ্লেচার। এমনকি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশী কোচ!
ফ্লেচারের অধীনে ইংলিশরা প্রথম জয় পায় ফ্লেচারেরই দেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই। তাঁর অধীনে ৩১ বছর পর উইজডেন ট্রফি জয় পায় ইংলিশরা। ফ্লেচারের বড় গুণ ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। মার্কাস ট্রেসকোথিক, মাইকেল ভন ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফদের তিনিই উঠিয়ে এনেছিলেন জাতীয় দলে।
২০০০ সালে পাকিস্তান সফরে যায় ইংল্যান্ড। সেখানে ইংলিশ ব্যাটারদের জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল সাকলাইন মুশতাকের স্পিন! সেটির সমাধানও সহজেই বের করে ফেলেন ফ্লেচার। ‘ফরোয়ার্ড প্রেস’ নামক নতুন এক টেকনিক বের করেন তিনি। এতে সহজেই সাকলাইন মুশতাকের বল মোকাবেলা করেছিল ইংলিশ ব্যাটাররা। সেবার ৩৯ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয় পায় ইংল্যান্ড।
১৯৮৬ সালের পর আর লম্বা সময় অ্যাশেজ জিততে পারেনি ইংল্যান্ড। ফ্লেচারের অধীনে প্রায় ১৯ বছর পর ২০০৫ সালে আবারও অ্যাশেজ নিজেদের করে নেয় ইংলিশরা। আর তাতেই পুরষ্কার স্বরূপ ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান তিনি!
২০০৭ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে কোচিং করান তিনি। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের হয়েও কোচিং করিয়েছেন ফ্লেচার। ২০১১ সালে ভারতের কোচ হবার প্রস্তাব পেলেন তিনি! গ্যারি কারস্টেনের অধীনে বিশ্বকাপ জয়ের পর কারস্টেনের পরামর্শেই ফ্লেচারকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় ভারত। অবশ্য ভারতের কোচ হবার পর থেকেই সমালোচনার বৃত্তে ঢাকা ছিলেন তিনি। মহিন্দর অমরনাথ, স্টিভেন ফ্লেমিং, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো অপশন হাতে থাকা সত্ত্বেও কেনো ফ্লেচারকে নেওয়া হলো এতে ক্ষুব্ধ হন বেশ কিছু সাবেক ক্রিকেটারও!
বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেব তো সরাসরি বলে দেন, ‘ডানকান ফ্লেচার – সে কে? খেলোয়াড় হিসেবে আমি তাঁর ব্যাপারে তেমন কিছুই মনে করতে পারছি না। আমি ভেঙ্কটেশ প্রসাদ কিংবা রবিন সিংকে কোচ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। তাঁরা ভারতীয় বলেই নয় কি! ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরও তাঁরা বিবেচিত হল না।’
এতো সমালোচনার পরেও প্রায় চার বছর ভারতের হয়ে কোচিং করানোর সুযোগ পান ফ্লেচার। ২০১৫ সালে মেয়াদ শেষে আর চুক্তি নবায়ন করেনি বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। এর মধ্যে তাঁর অধীনেই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় করে ভারত।
৬ ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে ৪৮ গড়ে ২ ফিফটিতে করেছেন ১৯১ রান। এছাড়া বল হাতে শিকার করেছেন ৭ উইকেট। অজিদের বিপক্ষে ম্যাচ সেরা ৪২ রানে ৪ উইকেটই ক্যারিয়ার সেরা।
এই ছোট্ট ১১ দিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও তিনি জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এক অনন্য কীর্তিতে নাম লিখিয়েছেন। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়েছেন সেটিও নিজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে। তাঁর অভিষেক ম্যাচটাই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জন্য এক ইতিহাস। ক্রিকেটার হিসেবে খুব বড় অর্জন না থাকলেও কোচ হিসেবে পরবর্তীতে অর্জন করেছিলেন সম্মান।