সময়ের আগেই প্রস্থান

বলা হয়, সময় মত বিদায় নিতে পারাটা একটা আর্ট।

অনেকে সময় পার হয়ে যাওয়ার পর বিদায় নেন, ফলে তাঁদের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার অনেকে সময় হওয়ার আগেই ‘বিদায়’ বলে দেন।

জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থাকাটা যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য বিশাল এক লড়াই। কেউ এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে আবার কেউ টিকে থাকতে না পেরে বিদায় জানায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে।

আরো পড়ুন

কেউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে জাতীয় দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। আবার অনেকে ইনজুরির কারণে জাতীয় দলেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। ফলাফল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সময়ের আগে বিদায় নেওয়া। যেসব ভারতীয় ক্রিকেটার বেশ আগেই ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন তাদেরকে নিয়ে এই আয়োজন।

  • রবি শাস্ত্রী

ভারতীয় দলের বর্তমান হেড কোচ রবি শাস্ত্রী খেলোয়াড়ী জীবনে ছিলেন একজন অলরাউন্ডার। তিনি মাত্র ৩০ বছরে বয়সে ইনজুরি জনিত সমস্যার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় দেওয়ার কিছুদিন আগে ইংল্যান্ড সফরে দুইটি সেঞ্চুরি করে ভারতীয় দলে ওপেনিং পজিশনে নিজের অবস্থান পাকা করেছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলা শুরু করেন। দুই বছর পর ১৯৯৪ সালে পেশাদার ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি, এরপর ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেবার আগে প্রায় ২০ বছর ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮০ টেস্টে ৩৮৩০ রান করেছিলেন এবং বল হাতে শিকার করেছেন ১৫১ উইকেট। আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ১৫০ ম্যাচে ব্যাট হাতে করেছেন ৩১০৮ রান এবং বল হাতে শিকার ১২৯ উইকেট।

  • প্রবীন কুমার

প্রবীন কুমার ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা প্রতিশ্রুতিশীল পেসার। কিন্তু নিজেকে সঠিকভাবে প্রমান করতে পারেননি তিনি। বিশ্বে কম সংখ্যক বোলার ছিলেন (বা আছেন) যারা প্রবীন কুমারের মত বল সুইং করাতে পারে। যেকোনো ধরনের উইকেটে কার্যকর ছিলেন প্রবীন কুমার।

ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে ব্যাটসম্যানদের বেশ ভালো ভুগিয়েছেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও বেশ আগেই নিজের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

ইনজুরির সাথে লড়াই করে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রবীন কুমার। এর ফলে ২০১৮ সালে বাধ্য হয়ে মাত্র ৩২ বছরে বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে বাধ্য হন তিনি।

ভারতের হয়ে সাদা পোষাকে মাঠে নেমেছিলেন মাত্র ৬ টেস্টে। এই সময়ে তিনি শিকার করেছিলেন ২৭ উইকেট। ওয়ানডেতে একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন ৬৮ ম্যাচে এবং টি-টোয়েন্টিতে মাঠে নেমেছিলেন ১০ ম্যাচে। ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে বল হাতে যথাক্রমে শিকার করেছিলেন ৭৭ এবং ৮ উইকেট।

  • মোহাম্মদ কাইফ

ভারতের সর্বকালের সেরা ফিল্ডার কে? এই প্রশ্নের জবাবে যে গুটি কয়েকের নাম আসবে তাঁর একজন হলেন মোহাম্মদ কাইফ। মজার ব্যাপার হল, তিনি আর ধোনি প্রায় সমসাময়িক ক্রিকেটার। অথচ, ধোনি যখন আজও আইপিএলে অধিনায়ক হয়ে মাঠে নামেন তখন কাইফ থাকেন ডাগআউটে।

মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়। ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে তাঁর করা ৮৭ রানের ইনিংসের জন্য তিনি আজীবনের জন্য ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে আছেন। তবে, ব্যাট হাতে ২০০৫-০৬ মৌসুমে বাজে সময় কাটান। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন ২০০৬ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫।

এরপর আর ফেরা হয়নি। কাইফের ক্যারিয়ার থামে ১৩ টেস্ট আর ১২৫ টি ওয়ানডেতে করেন সাড়ে তিন হাজারের মত রান।

  • প্রজ্ঞান ওঝা

টেস্ট ক্রিকেটে প্রজ্ঞান ওঝার অভিষেক ২০০৯ সালে। দলে এসেই হরভজন সিংয়ের সাথে গড়ে তোলেন দুর্দান্ত এক বোলিং জুটি। পরে হরভজনের বিদায়ের পর রবিচন্দন অশ্বিনের সাথে গড়ে তোলেন স্পিন বোলিং জুটি। অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হবেন লম্বা রেসের ঘোড়া। কিন্তু সেই লম্বা রেসের ঘোড়া হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। বোলিং অ্যাকশনজনিত সমস্যার কারণে মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েন।

২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট প্রজ্ঞান ওঝার ক্যারিয়ারেও শেষ টেস্ট হয়ে আছে। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো হয়নি তাঁর।

২০১৫ সালে বোর্ড অফ ক্রিকেট কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) তাঁর বোলিং অ্যাকশন সঠিক বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু তত দিনে জাতীয় দলে জায়গা পাকা করে ফেলেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। এই কারণে ২০১৩ সালের পর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়ে ওঠেনি।

প্রজ্ঞান ওঝা ভারতের হয়ে টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে মাঠে নেমেছেন যথাক্রমে ২৪, ১৮ এবং ৬ ম্যাচে। ২৪ টেস্টে উইকেট নিয়েছেন ১১৩ টি এবং ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে যথাক্রমে শিকার করেছেন ২১ এবং ১০ উইকেট।

  • সাবা করিম

ভারতীয় ক্রিকেটে ইনজুরির কারণে বেশ আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষ হয়ে যাওয়া আরেক জন ক্রিকেটার। তিনি ভারতের হয়ে মাত্র এক টেস্টে মাঠে নামতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচে টেস্ট ক্যারিয়ারের অভিষেক হয়েছিল সাবা করিমের। এটাই সাবা করিমের ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ হয়ে আছে। একই ভেন্যুতে এশিয়া কাপের ম্যাচে অনিল কুম্বলের একটি বল বেলে লেগে বেল তাঁর চোখে আঘাত করে। এর ইনজুরির কারণে ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে দীর্ঘ করতে পারেননি তিনি।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানিয়ে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন। ২০১২ সালে জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে কাজ শুরু করেন।  এরপরে বিসিসিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। এর মেয়াদ আছে ২০২১ সাল পর্যন্ত।

  • ইরফান পাঠান

বয়স মাত্র ৩৬ কি ৩৭। সাবেক সতীর্থরা, এমন কি সিনিয়ররাও দিব্যি আইপিএল খেলে যাচ্ছেন। কিন্তু, ইরফান পাঠান নেই। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন।

অথচ, কি দুর্ধর্ষ এক পেসার হয়েই তিনি এসেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে অভিষেক। তাঁর স্যুুইং দেখে রীতিমত ওয়াসিম আকরামের কথা মনে পড়তো।

ব্যাটিং জানতেন ভালই। স্বয়ং কপিল দেবের সাথে তুলনাও হত। আর সেটাই কাল হল। ব্যাটিংয়ে মন দিতে গিলে বোলিংয়ে খেই হারালেন। সাথে যোগ হল ইনজুরি। আর ফিরতে পারলেন না। শেষ যখন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন বয়স তখন ২৭।

ক্যারিয়ারে ২৯ টি টেস্ট, ১২০ টি ওয়ানডে আর ২৪ টি টি-টোয়েন্টি খেলেন। ৩০০-এর ওপর উইকেট পান, তিন হাজারের মত রান করেন। নি:সন্দেহে তাঁর আরও কিছু দেওয়ার ছিল ভারতকে।

  • নরি কন্ট্রাকটর

নরি কন্ট্রাকটর ভারতের অন্যতম বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জাতীয় দলে নরি কন্ট্রাকটর। ১৯৫৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর এবং আস্তে আস্তে ভালো পারফর্ম করে উপরে উঠছিলেন। তিনি বেশ দ্রুতই নিয়মিত পারফর্ম করছিলেন এবং ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন।

১৯৬২ সালে চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে আঘাত পান। এর ফলে বেঁচে থাকার জন্য সার্জারির করতে হয় এবং পরবর্তীতে জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি। এর ফলে ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে হয় তাঁকে। নরি কন্ট্রাকটর ভারতের হয়ে ৩১ টেস্টে ১ সেঞ্চুরিতে ১৬১১ রান করেন।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link