একটি ফোন কল ও একজন এনামুল জুনিয়র

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হোটেলে বসে এনামুল হক জুনিয়র কী যেন ভাবছেন! ভাবছিলেন দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। রাতে বাসা থেকে ফোন আসে তাঁর। ফোনের অন্যপাশ থেকে মাও ছেলেকে জানিয়ে দিলেন যে নিজের জন্য নয়, আগে দেশের জন্য কিছু করতে হবে।

রাত পোহালেই ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম দিনের খেলা।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হোটেলে বসে এনামুল হক জুনিয়র কী যেন ভাবছেন! ভাবছিলেন দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। রাতে বাসা থেকে ফোন আসে তাঁর। ফোনের অন্যপাশ থেকে মাও ছেলেকে জানিয়ে দিলেন যে নিজের জন্য নয়, আগে দেশের জন্য কিছু করতে হবে।

পরদিন পঞ্চম দিনের খেলা শুরু হলো। ৩৮০ রানের টার্গেটে আগের দিন ৩ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে চতুর্থ উইকেটে হ্যামিলটন মাসাকাদজা ও ব্র্যান্ডন টেইলর ৭০ রান যোগ করে প্রতিরোধ গড়ে তুলার চেষ্টা করে। তখনই ধস নামে জিম্বাবুয়ের ইনিংসে। ১১২ রানে ৪ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৫৪ রানে।

জিম্বাবুয়ে শেষ ৪৩ রান তুলতে হারায় ৭ টি উইকেট যেখানে ৫ টি উইকেটই নিজের পকেটে পুড়েন এনামুল হক জুনিয়র। সেদিন বল হাতে আসল ভেলকিটা দেখিয়েছিলেন তিনিই। ২২.২ ওভারে ৫ মেইডেনসহ মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে ২২৬ রানের বিশাল একটি জয় উপহার দেন এনামুল। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের হলেও জয়টি খুব স্পেশাল ছিল বাংলাদেশের জন্য।

কারণ এটি ছিল ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয়।

বাংলাদেশ আইসিসির টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা পায় ২০০০ সালের ২৬ জুন। একই বছরের নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলে বাংলাদেশ যেখানে ভারত জয় লাভ করে। টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের প্রথম জয় পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয় ৪ বছর ৬ মাস ১৪ দিন।

এই সময়টাতে বাংলাদেশ মোট টেস্ট খেলে ৩৪ টি। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ফলাফল ছিল ড্র। ৩৪ ম্যাচে বাংলাদেশ ড্র করেছিল তিনটি আর হেরেছিল ৩১ টি টেস্টে। তিনটি ড্রয়ের মধ্যে দুটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আর একটি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিপক্ষে। ২০০১ সালের নভেম্বরে ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম ড্র করে বাংলাদেশ। তারপর ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এবং একই বছর মে মাসে গ্রস আইসলেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ড্রয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ।

এর মধ্যে ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান টেস্ট জয়ের জোর সম্ভাবনা জাগালেও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের হার মাত্র ১ উইকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে একের পর এক হারে বিধ্বস্ত হতে থাকে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। লড়াই করেও তাদের দেখা মিলে না একটি জয়ের। হারতে হারতে হাপিয়ে উঠা বাংলাদেশের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে মুলতানে সেই এক উইকেটের হারে।

একের পর এক ম্যাচ হারার পাশাপাশি টেস্ট জয়ের জন্য নিজেদের আত্মবিশ্বাসটাও হারিয়ে ফেলতে থাকে বাংলাদেশ। একটা সময় টেস্ট জয়ের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে খেলোয়াড়দের। তবে পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে তাদেরকে সাহায্য করে ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে জয়।

ক্রিকেট ইতিহাসে নিজেদের সেই প্রথম ওয়ানডে জয়ের পর সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা ফিরে আসে যে চেষ্টা করলে টেস্ট ম্যাচও জেতা সম্ভব। ভারতকে হারানোর পর সবার মধ্যে এই বিশ্বাসটা আসে যে তাঁরাও টেস্ট জিতবে। আর সবার আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে ঠিক তার পরের সিরিজেই।

২০০৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে পরিসংখ্যান কথা বলছিল জিম্বাবুয়ের পক্ষে। কারণ এর আগে টেস্টে ৬ বারের মোকাবেলায় ৪টিতেই জয় জিম্বাবুয়ের, আর বাকি দু’টি ম্যাচ ড্র হয়েছিল। কিন্তু সিরিজের প্রথম ম্যাচে এসব পরিসংখ্যান কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বাংলাদেশ শিবিরে।

ইস্পাতদৃঢ় মনোবল ও পাহাড়সম আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে মাঠে নামে বাংলাদেশ। অন্যান্যবারের মত তাই এবার আর পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়নি তাদের। কারণ তাদের আত্মবিশ্বাসের কাছে শেষ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে অধরা জয়টি ধরা দিতে বাধ্য হয়।

২০০৫ সালের সেই দিনে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে নিজেদের ৩৫ তম ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১৭৩৩ তম টেস্ট ম্যাচে এসে প্রথম জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচেই বহুল কাঙ্ক্ষিত জয়টি পায় বাংলাদেশ।

প্রথমে ব্যাট করে অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের ৯৪, রাজিন সালেহ’র ৮৯, মোহাম্মদ রফিকের ৬৯ নাফিস ইকবালের ৫৬ ও খালেদ মাসুদের ৪৯ রানের ওপর ভর করে ১৪৯.৩ ওভারে ৪৮৮ রানের বড় পুঁজি পায় বাংলাদেশ। দলীয় সংগ্রহকে পর্বতে পরিণত করতে অবদান ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজারও। দলীয় ইনিংসের শেষ দিকে মাত্র ৪৪ বলে ৮ চার ও ১ ছয়ে তাঁর ৪৮ রানের ইনিংসটি যে তাই প্রমাণ করে।

তখন ১৪৯.৩ ওভারে ৪৮৮ রানের ইনিংসটিই ছিল টেস্টে বাংলাদেশের দীর্ঘতম ইনিংস। ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়েও বাংলাদেশ ছিল অপ্রতিরোধ্য। মোহাম্মদ রফিকের ৫ ও মাশরাফি বিন মুর্তজার ৩ উইকেটে বাংলাদেশ লিড পায় ১৭৬ রানের।

দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য ব্যাটিংটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের। হাবিবুল বাশারের ৫৫ রান ছাড়া বলার মত তেমন কোন ইনিংস খেলতে পারেনি বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান। ৯ উইকেট হারিয়ে ২০৪ রানে ইনিংস ঘোষণা করলে জিম্বাবুয়ের জন্য টার্গেট দাঁড়ায় ৩৮০ রানের। আর বাকি গল্পটা তো লেখার শুরুতেই বলা হয়ে গেছে।

টেস্টের চতুর্থ দিন দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণার পর অধিনায়ক হাবিবুল বাশার স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রকে দেশের জন্য কিছু একটা করতে বলেছিলেন। অধিনায়কে হতাশ করেননি এনামুল, হতাশ করেননি বাংলাদেশকে।

সেদিন এনামুল হক জুনিয়র অধিনায়কের কথা রেখেছেন; রেখেছিলেন আগেরদিন রাতে তাঁর মায়ের বলা কথা। দেশকে একটা টেস্ট জয় উপহার দিতে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন মাঠে। বাঁ-হাতি স্পিন ঘূর্ণিতে ৪৫ রানে ৬ উইকেট নিয়ে সেদিন ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছিলেন এনামুল, নাম লিখিয়েছিলেন দলের বাকি ১০ জনেরও।

সেদিন পুরো দেশকে প্রথম টেস্ট জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। নিজেও ভেসেছিলেন আনন্দে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...