কোনও একটা বিশ্বকাপের কথা যদি ধরা হয় যেটা কোনও একজন ফুটবলার একার ক্ষমতায় প্রায় জিতেছেন, তাহলে আমরা ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার কথা বলি। কিন্তু তারও ২৪ বছর আগে, রিও ডি জেনেরোর ম্যানুয়েল ফ্রান্সিস্কো ডস স্যান্টোস একই কাজ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে চিলি বিশ্বকাপে মানে গ্যারিঞ্চার যা পারফরম্যান্স, তা সহজেই বলা চলে একক দক্ষতায় তিনি বিশ্বকাপ জিতে এনেছিলেন ব্রাজিলের জন্য দ্বিতীয়বার।
পেলে গ্রুপ লিগের দ্বিতীয় ম্যাচেই চোট পান, পুরো বিশ্বকাপে আর খেলা হয়নি। তবে পেলের স্থলাভিষিক্ত হন আমারিল্ডো, বোটাফেগোর আমারিল্ডো। আমারিল্ডো আর দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার ছাড়া ব্রাজিলের ১৯৫৮র প্রথম দলটাকেই ধরে রাখা হয়েছিল ১৯৬২তে। তাহলে গ্যারিঞ্চার বিশ্বকাপ কেন বলা হচ্ছে? বা এই ম্যাচটাই কেন বেছে নেওয়া হল?
১৯৬২র বিশ্বকাপের ইংল্যন্ড দলটার দিকে তাকালে তার চার বছর পরের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যন্ডের ৫ জন ’৬২-এর কোয়ার্টার ফাইনাল দলে ছিলেন। আর ইংল্যন্ড বিশ্বকাপে বেশ ভালোই ফর্মে, শক্তিশালী হাঙ্গারির কাছে ২-১ হারা ছাড়া ববি চার্লটনের দুর্দান্ত ফর্মে আর্জেন্টিনাকে হারায় তারা। এবং শেষ ম্যাচে ড্র করলেই যেখানে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেখানে তারা খুব বেশি ঘাম ঝরায়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় যে, আগের বিশ্বকাপে গ্রুপ লিগের ম্যাচে ইংল্যন্ড ডিফেন্স ব্রাজিলকে দাঁত ফোটাতে দেয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মধ্য চিলির ভিনা দেল মারের এস্তাদিও সাউসালিতোয় মুখোমুখি হল চার্লটনের ইংল্যন্ড এবং গ্যারিঞ্চা, ডিডি, ভাভার ব্রাজিল। ডিডি, নিলটন ও জালমা স্যান্টোসের বয়স হয়েছে। ভাভা একেবারেই ফর্মে নেই। কিন্তু গ্যারিঞ্চা যেন অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন কাঁধে।
দুই কোচই তখনকার জনপ্রিয় ৪-২-৪ সিস্টেমে দলকে নামিয়েছেন। ইংল্যন্ড দলের ববি চার্লটন যেমন, মাঝ মাঠে একটা মোবাইল পজিশনে খেলেন তেমনই ব্রাজিলে ডিডি এবং জিটো ডিফেন্সের দায়িত্ব সামলে আক্রমণে সহায়তা করতে উঠে যাচ্ছেন ইনসাইড রাইট এবং ইনসাইড লেফট হিসেবে। দুই স্যান্টোস তখন ইনভার্ট করে মাঝ মাঠ কভার করছেন।
ইংল্যন্ড অবশ্য ৪-২-৪এ দল সাজালেও প্রতিআক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথম সুযোগটা অবশ্য ইংল্যন্ডই পায়। ইংল্যন্ডের লেফট উইঙ্গার ব্রায়ান ডগলাস একটা হাফটার্নে ব্রাজিলের ডান প্রান্তিক সেন্টার ব্যাক জোজিমোকে ফলস দিয়ে গোলে শট নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বল গোলের অনেক দূর দিয়ে দর্শকাসনে আশ্রয় নিয়েছিল।
অপরদিকে, মিনিট তেরোর মাথায় বাঁ-দিক দিয়ে জাগালোর প্রান্তবদলকারী পাস ধরে গ্যারিঞ্চা বাঁ-দিকের হাফ ব্যাক নর্মানকে জমি ধরিয়ে যে মাইনাস কাম গোল লক্ষ্য করে শটটি নেন, সেটি ইংল্যন্ডের গোলকিপার স্প্রিংগেট জায়গা থেকে সরে গিয়ে ফস্কান, গোললাইন থেকে ইংল্যন্ডের রাইট ব্যাক আর্মফিল্ড না বাঁচালে তখনই ইংল্যান্ড পিছিয়ে পড়ত।
গ্যারিঞ্চার উপর সেদিন বোধহয় দৈত্য ভর করেছিল। হঠাৎ আউটসাইড ডজে মরিস নর্মান এবং ববি মুর উভয়কেই টালমাটাল করে হরিণ গতিতে ঢুকে পড়ছেন বক্সে, মাইনাস রাখছেন, বা শট নিচ্ছেন। সামাল দেবার জন্য বারবার ববি চার্লটনকে নামতে হচ্ছে।
এরই মাঝে গোল এল। গোল এল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে। বাঁ-দিক থেকে মারিও জাগালোর কর্নার এবং ইংল্যান্ড ডিফেন্স যখন ডিডি, ভাভা এবং আমারিল্ডোকে মার্ক করতে ব্যস্ত তখন বক্সের মাঝ খান থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় স্পট দিয়ে উঠে দ্বিতীয় পোস্টে বল রাখলেন জোরালো হেডে মানো গ্যারিঞ্চাই। স্প্রিংগেটের কিছু করার ছিল না। পুরো ৯০ মিনিট জুড়েই ব্রাজিল সেটপিস থেকে হূল ফুটিয়ে গেছে ইংল্যন্ডকে। জেরবার হয়েছে ইংল্যন্ড।
আমারিল্ডো, ভাভা এবং গ্যারিঞ্চা নিজে ধনী বাপের বিগড়া হুয়া সন্তানের মতো সুযোগ অপচয় করছেন, ইংল্যন্ড ডিফেন্সের অবস্থা একদম অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পুরনো বাড়ির মতো, অন্তঃপুর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে আছে।
এমতাবস্থাতেই, একটা সাধারণ নিরামিষ কর্নার ক্লিয়ার করতে গিয়ে ব্রাজিলিয়ান সেন্টার ব্যাক জোজিমোর হেডার বারে লেগে ফিরে এলে সামনে থাকা সেন্টার ফরোয়ার্ড গ্যারি হিচেন্স দ্রুত পা ছুঁইয়ে ১-১ দেন। গোলটা খেয়ে সামান্য হলেও খেই হারিয়ে ফেলে ব্রাজিল। হাফ টাইমের তখনও মিনিট ছয়েক বাকি, কিন্তু কোনও সুযোগ সৃষ্টি হল না।
দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল আবার বিরতির পর পুরোদমে নামে মাঠে। বাঁ দিক থেকে জাগালো সঙ্গত করছিলেন বটে। কিন্তু ডানদিকে গ্যারিঞ্চা বলে বলে ডিফেন্ডারদের এস্তাদিও সাউসালিতোর ঘাস চেনাচ্ছেন। একটা ছোট্ট ঝটকা, সামান্য ঝুঁকে চোরা গতি তোলা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলের উপর নজর রাখা, আর ডিফেন্ডারের বাড়ানো পা গতিতে পেরিয়ে যাওয়া।
ডানদিক থেকে পাওয়া একটা ফ্রিকিকে ইনস্টেপ রাখলেন দশ গজের বক্সে গ্যারিঞ্চা। ম্যাচের ঘড়িতে তখন ৫৩ মিনিট। স্প্রিংগেট কোনোরকমে বাঁচালেই বল এল ভাভার মাথায়। সামান্য লাফিয়ে ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে কসুর করেননি ভাভা।
২-১এ এগিয়ে থাকার পর ব্রাজিল ছেলে খেলা শুরু করল ইংল্যন্ডকে নিয়ে। গত ছ বছরে তারা ইউরোপীয় দলের কাছে হারেনি। চার বছর আগে ইউরোপ থেকেই প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে ‘জিঙ্গা’ ফুটবল খেলে। এবারে দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে নশ্বর মানুষ কে কী করবে তাদের? যেখানে এক পাঁচফুট সাতের ঐশ্বরিক মূর্তি সামান্য বাঁকা ডান পা নিয়ে শাসন করছে মাঠে।
মিনিট ছয়েকের মধ্যেই ম্যাচের সেরা গোলটা এল। ইংল্যন্ড হতোদ্যম হয়ে পড়েছে, চার্লটন আর আগের মতো উৎসাহ নিয়ে নিচে নামছেন না, এই অবস্থায় ডিডির একটা লম্বা পাস সামান্য লাফিয়ে নামিয়ে দিলেন আমারিল্ডো। গোল থেকে তিরিশ গজ দূরে বলটা নিয়ে মানো গ্যারিঞ্চা দু কদম এগিয়ে ইনস্টেপ দিয়ে একটা দৈব শট নিলেন, বলটা সামান্য উঠে গিয়ে গতিতে স্প্রিংগেটকে পরাস্ত করে গোল পোস্টের বাঁদিকের উপরের কোণে আশ্রয় নিল। ৩-১। এর পরে আধঘণ্টা শুধু প্রদর্শনী ফুটবল খেলা হল। ইংল্যন্ড বল ধরতে পারল না, ব্রাজিল নিজেদের মধ্যে টিকরমবাজি করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করল।
গ্যারিঞ্চা এর পরে সেমিফাইনালেও দুটি গোল করেন এবং ফাইনালে ম্যাসোপুস্টের চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে দুটো গোলের বল সাজিয়ে দেন।
কিন্তু ম্যারাডোনার বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ’৮৬-এর সেমিফাইনালের মতোই প্রায় সম্পূর্ণ একক দক্ষতায় ইংল্যান্ডকে অতলান্তিক পার করিয়ে দেন গ্যারিঞ্চা। আর ব্রাজিলকে নিয়ে যান সোনার পরীর আরও নিকটে। দ্বিতীয়বারের জন্য। বিশৃঙ্খলা এবং ড্রাগ সমস্যায় নিজের শরীরটাকে দুরমুশ না করে ফেললে হয়তো আজ পেলে ম্যারাডোনার সঙ্গেই উচ্চারিত হত গ্যারিঞ্চার নাম। কিন্তু না হলেই বা কী, আপামর ব্রাজিলবাসীর মনে তিনিই মুকুটহীন যুবরাজ হয়ে রয়ে গেছেন আজ ষাট বছর পরেও।