ইংল্যান্ড-পাকিস্তান প্রথম টেস্ট: টেকিং পয়েন্টস

পুরোটা টেস্ট জুড়ে পাল্লাটা পাকিস্তানেরই ভারি ছিল। তবে, চতুর্থ দিন সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয় ইংল্যান্ড। উইকেটরক্ষক জশ বাটলার ও অলরাউন্ডার ক্রিস ওকসের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ উইকেটের দুর্দান্ত জয়ের স্বাদ পায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড।

করোনাভাইরাসের কারনে গেল কয়েক মাস ধরে ক্রিকেটের বাইরে ছিলো পাকিস্তান। তারপরও প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনের প্রথম সেশন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের উপর আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছে পাকিস্তান। ২৭৭ রানের টার্গেট দিয়ে ১১৭ রানের মধ্যে ইংল্যান্ডের ৫ উইকেট তুলে নিয়ে এক সময় জয়ের স্বপ্ন দেখছিলো পাকিস্তান। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে বাটলার ও ওকসের ১৩৯ রানের দুর্দান্ত জুটিতে পাকিস্তানের হাত থেকে জয় ফসকে যায়। বাটলার ৭৫ ও ওকস অপরাজিত ৮৪ রান করেন।

প্রথম টেস্ট শেষে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখে পড়েছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির। সেগুলোতে নজর দেয়া যাক।

  • বিস্ময়কর পারফরমেন্স ওকসের

গেল মাসে শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ক্যারিয়ারে ১হাজার রান ও ১শ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেন ওকস। কিংবিদন্তি ক্রিকেটার ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স, ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস ও স্টুয়ার্ট ব্রডের চেয়েও কম টেস্ট খেলে এক হাজার রান ও ১০০ উইকেট শিকার করেন ওকস।

তবে ঐ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগই পাননি ওকস। অবশ্য তাতে অবাক বা আলোচনায় ছিলেন না তিনি। বাদ পড়েও হাল ছাড়েননি ওকস। একাদশে নিজের জায়গা ফিরে পেতে লড়াই করে গেছেন। পরের দুই টেস্টে ১১টি উইকেট শিকার করে দলে নিজের জায়গা পাকা করার দাবী নিশ্চিত করতে পেরেছেন ওকস। তারপরও পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে অনিশ্চিত ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫০ রানে ৫ উইকেট নেয়ায়, একাদশে সুযোগের ভালো সম্ভাবনা ছিলো তার।

বোলার হিসেবে সুযোগ পেয়ে চার উইকেট নেন ওকস। কিন্তু ব্যাট হাতে ওকসের হাতে যে জাদু আছে, তা কিন্তু অনেকেই ভুলতে বসেছিলেন। অথচ তার ৩৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে একটি সেঞ্চুরি রয়েছে।

২০১৮ সালে লর্ডসে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৭ রান করেছিলেন ওকস। ঐ ইনিংসের আগে ৪টি হাফ-সেঞ্চুরিও করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেঞ্চুরির পর কোন ইনিংসে হাফ-সেঞ্চুরির ধারেকাছেও যেতে পারেননি ওকস। খেলেছিলেন ১৭টি ইনিংস। হয়তো ব্যাট হাতে প্রয়োজনীয় সময়ে বীরত্ব দেখাতেই, নিজের প্রতিভা জমিয়ে রেখেছিলেন ওকস।

সর্বশেষ ছয় টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৫ দশমিক ২২। তাই এই ব্যাটিং গড়ে, তার কাছ থেকে রান আশা করাটাও বোকামি। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়েছেন ওকস। দল যখন খাদের কিনারায় তখনই ব্যাট হাতে চমক দেখালেন তিনি। পাকিস্তানের পেসারদের বাউন্সার, নতুন বলের সুইং ও স্পিনারদের বৈচিত্র্যকে দক্ষতার সাথে সামাল দিয়েছেন ওকস। দুর্দান্ত সব শটে, মাত্র ৫৯ বলে হাফ-সেঞ্চুরি করেন ওকস।

তার ও বাটলারের আক্রমানাত্মক ব্যাটিংএ ম্যাচ লাগাম ছুটে যায় পাকিস্তানের হাত থেকে। ম্যাচ শেষে সেটি স্বীকারও করেন পাকিস্তানের অধিনায়ক আজহার আলী। তিনি বলেন, ‘ইংল্যান্ডের পঞ্চম উইকেট পতনের পর, আমরা আরও এক বা দুই ব্যাটসম্যানকে শিকারের পরিকল্পনা করছিলাম, কিন্তু ঐ সময় বাটলার-ওকসের আক্রমনাত্মক ব্যাটিং আমাদের ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়।

পরবর্তীতে বাটলার থামলেও, ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন ম্যাচ সেরা ওকস। তাই ওকসকে মি. ডিপেন্ডেবল বলতে মুখে আটকায়নি ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জো রুটের। তিনি বলেন, ‘সে হলো মি. ডিপেন্ডেবল। সে এমন একজন, আপনি যার উপর ভরসা রাখতে পারেন অবশ্যই আপনি যান চান।

  • বাটলারের ভয়-শঙ্কা

পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামার আগে বাটলার জানতেন, এই ম্যাচে ভালো করতে না পারলে, এটিই হবে বড় ফরম্যাটে তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। ওয়ানডে ক্রিকেটের মারমুখী ব্যাটসম্যান, টেস্টে পুরোপুরিই ফ্লপ।
২০১৪ সালে টেস্ট অভিষেকের পর বাটলারের উইলো থেকে এসেছে মাত্র একটি সেঞ্চুরি।

গত অ্যাশেজে করেন একটি হাফ-সেঞ্চুরি। এরপর ১৪ ইনিংস ছিলেন সেঞ্চুরি ও হাফ-সেঞ্চুরিহীন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ টেস্টে ৬৭ রান তাকে দলে রাখার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন তিনি। অবশ্য বাটলারকে একাদশের রাখার ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন কোচ ক্রিস সিলভারউড ও অধিনায়ক জো রুট। তাদের ভাষ্য, এমন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের আরও সুযোগের প্রয়োজন।

সুযোগ পেয়েই নিজের জাত দেখিয়েছেন বাটলার। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৩৮ রান মন ভরাতে পারেনি তার। পাশাপাশি ঐ ইনিংসে উইকেটের পেছনে দু’টি ক্যাচও ছেড়েছেন তিনি। এরমধ্যে পাকিস্তানের সেঞ্চুরিয়ান শান মাসুদের ক্যাচও ছিলো। ৪৫ রানে জীবন পেয়ে ১৯৯৬ সালের পার কোন পাকিস্তানী ওপেনার হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন মাসুদ। পরবর্তীতে ১৫৬ রানের ইনিংস খেলে পাকিস্তানকে বড় সংগ্রহই এনে দেন মাসুদ।

প্রথম ইনিংসে ব্যাট ও উইকেটের পেছনে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায়, দলে টিকে থাকা নিয়ে ভয়-শঙ্কার মধ্যেই ছিলেন বাটলার।

তবে নিজেকে শেষবারের মত প্রমানের জন্য বড় সুযোগই পান বাটলার। দলকে নিশ্চিত হার থেকে রক্ষা করে, দলে নিজের জায়গা ধরে রাখলেন তিনি। তবে ম্যাচ শেষে নিজের কিপিং নিয়ে হতাশ ছিলেন বাটলার, ‘আমি জানি, আন্তর্জাতিক উইকেটরক্ষক হিসেবে এটি মোটেও যথেষ্ট নয়। যদি এই দলে আমাকে টিকে থাকতে হয়, তবে উইকেটের পেছনের দায়িত্বটা ভালোভাবে পালন করতে হবে, এজন্য আরও উন্নতি করতে হবে।

  • মাসুদের অধ্যবসায়ের পুরস্কার

সর্বশেষ ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন পাকিস্তানের ওপেনার মাসুদ। সে সফরে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ১৭ দশমিক ৭৫।
পরবর্তীতে দল থেকে বাদ পড়লেও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে নিজেকে নিয়ে কাজ করেছেন মাসুদ। ঘরোয়া আসরে পারফরমেন্স করে দলে ফিরলেও, নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছিলেন না তিনি।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ড সফর শেষে, ১৮ ইনিংসে তিনটি হাফ-সেঞ্চুরি করেন মাসুদ। তারপরও মাসুদের উপর আস্থা ছিলো পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক, বর্তমান কোচ ও প্রধান নির্বাচক মিসবাহ উল হকের। সেই আস্থার প্রতিদান দেন তিনি।

গেল বছরে দেশের মাটিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে সেঞ্চুরি করেন মাসুদ। এই শ্রীলংকার বিপক্ষেই ২০১৫ সালে পাল্লেকেলেতে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি।

গেল বছর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির পর ব্যাট হাতে আরও জ্বলে উঠেন মাসুদ। শ্রীলংকার পর বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টেও সেঞ্চুরি করেন তিনি। ফলে টানা দু’টি সেঞ্চুরি করে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখেন মাসুদ। তার সামনে ছিলো হ্যাট্টিক সেঞ্চুরির সুযোগ। সুযোগটা হাতে-নাতে কাজে লাগান তিনি। ম্যানচেষ্টার টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ১৫৬ রান করে ফেলেন মাসুদ। ফলে টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করে কোচ মিসবাহসহ পাকিস্তানের ছয় ব্যাটসম্যানের পাশে নাম তুললেন মাসুদ।

তার এই আট ঘন্টার ইনিংসে লক্ষ্য করা গেছে, ধৈর্য্য-ঠান্ডার মাথায় খেলা ও শর্ট নির্বাচনে দক্ষতা। তাই মাসুদের ইনিংসের প্রশংসা করে পাকিস্তানের কোচ মিসবাহ বলেন, ‘এটি দারুন ইনিংস ছিলো এবং কঠোর পরিশ্রমের ফল পেয়েছে সে। ইংল্যান্ডেই নিজেকে প্রমান করেছে সে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link