দলগত খেলা ফুটবলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব থাকে। যেমন ধরুন গোলকিপারের দায়িত্ব গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের শট ঠেকানো, ডিফেন্ডারের দায়িত্ব প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা। তেমনি করে একজন স্ট্রাইকারের দায়িত্ব গোল করা।
মিডফিল্ড থেকে বিল্ডআপ করা বল কি করে জালে জড়াতে হয় এবং ডি-বক্সের আশেপাশে কখন কোন জায়গায় থাকলে বল পেয়ে তা জালের উদ্দেশ্যে ছোড়া যাবে তা জানা একজন স্ট্রাইকারের গুরুদায়িত্ব। ফুটবলীয় শৈলীর পাশাপাশি এসকল স্কিল বেশ ভাল ভাবেই রপ্ত করেছেন জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের তরুণ সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড আর্লিং হাল্যান্ড, দ্য ট্রু গোল মেশিন৷
৬ ফুট ৪ ইঞ্চি, গ্রিক রুপকথার কোন এক হিরোর মতো গড়নের গোল মেশিন হাল্যান্ড তাঁর ডর্টমুন্ড ক্যারিয়ারে ৬২ ম্যাচে করেছেন ৬০ গোল। একজন ২১ বছর বয়সী তরুণের হিসেবে পারফরম্যান্স সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
হ্যালান্ড, ২০০০ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের লিডস সিটিতে। বাবা ছিলেন সাবেক নরওয়ে জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় আলফ-ইনজে। বাবার থেকেই হয়ত ফুটবলীয় ডিএনএ মিউটেশান হয়ে এসেছে ছেলে আর্লিং ব্রুট হাল্যান্ডে।
হাল্যান্ড লাইমলাইটে আসেন ২০১৯-২০ মৌসুমে অস্ট্রিয়ান ক্লাব রেড বুল স্যালৎবার্গের থাকাকালীন। ক্লাবটির হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলাকালীন সময় টানা পাঁচ ম্যাচে পাঁচ গোল করে প্রথম কিশোর ফুটবলার হিসেবে তৈরি করেন ইতিহাস। সেই মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় কিশোর খেলোয়াড় হিসেবে ১০ গোল করার রেকর্ড গড়েন। এছাড়া অস্ট্রিয়ান ক্লাবটি হয়ে জেতেন অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা এবং অস্ট্রিয়ান কাপ।
এছাড়া মাত্র ২২ ম্যাচে ২৮ গোল করেন স্যালৎবার্গের হয়ে, পাঁচ হ্যাটট্রিকের কল্যাণে। মৌসুমে তাঁর বিস্ময়কর পারফরম্যান্স নজর কাড়ে বেশ কিছু ইউরোপিয়ান জায়েন্টদের। তবে সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্যালৎবার্গের সাথে থাকা ৫ বৎসরের চুক্তির উপেক্ষা করে ২০ মিলিয়ন ইউরোতে যোগ দেন জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে।
অর্ধেক মৌসুম খেলার সুযোগ হয় হাল্যান্ডের। তবে জার্মান বুন্দেসলিগায় তার অভিষেক ঘটে ইতিহাস গড়েই। লীগের ইতিহাসে প্রথম বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমে হ্যাটট্রিক করে দলের জয়ে রাখেন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মাত্র ২৩ মিনিটেই তিনি প্রমাণ করেন তার সামর্থ্য আর জানান দেন মেসি-রোনালদো পরবর্তী যুগে তিনিও থাকবেন রেকর্ড তৈরির প্রতিযোগিতায়। ৩-১ এ হারতে থাকা ম্যাচটি ডর্টমুন্ড জিতে নিয়েছিলেন ৫-৩ ব্যবধানে। ঘরের মাঠে অসবার্গ এফসি হয়ত ভুলতে চাইবে এমন একটি ম্যাচের কথা।
২০১৯/২০ মৌসুমের অর্ধেক সময়েই হ্যালান্ড গোল করেন ১৬টি মাত্র ১৮ ম্যাচে। তাছাড়া তিনি ডর্টমুন্ড ক্লাব ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বুন্দেসলিগা, ডিভিএফ পোকাল কাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক ম্যাচেই গোল করবার এক অনন্য রেকর্ড গড়েন।
২০২০/২০২১ মৌসুমে হাল্যান্ড হয়ে ওঠেন ভোরের আলোর ন্যায় অপ্রতিরোধ্য। যে আলোয় আলোকিত হয় বুন্দেসলিগা। মৌসুমে লিগের ২৮ ম্যাচে করেন ২৭ গোল, পাশাপাশি করেন ৯ অ্যাসিস্ট। ইনজুরির কারণে ৬ ম্যাচ মিস না করলে হয়ত গোল সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে পারতেন তিনি। তার বুন্দেসলিগায় গোল করার ক্ষমতা বা স্ট্রাইক রেট প্রায় ৮৭ এর কাছাকাছি। এর মানে দাঁড়ায় প্রায় প্রতি ৮৭ মিনিটে তিনি একটি করে গোল করেন নিজের দলের হয়ে। একজন আদর্শ স্ট্রাইকার।
ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার হাতছানি উপেক্ষা করে পিতৃভূমি নরওয়ের হয়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন এই তারকা। নরওয়ে বয়সভিত্তিক দলে স্বভাবচরিত খেলা প্রদর্শন করে পাঁচ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলতে নামেন মাল্টার বিপক্ষে।
এর আগে তিনি নরওয়ে অনূর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে যুব বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জেতেন তিনি। তাছাড়া সেই বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৯ গোল করে নিজের নাম খোদাই করেন নতুন এক রেকর্ডে। জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচে ১২ গোল আছে তাঁর ঝুলিতে।
স্ট্যাটিস্টিক্স একটু সাইডে রেখে যদি তার কৌশল নিয়ে কথা বলতে চাই তবে, প্রথমেই কথা বলতে হয় তার পজিশন সেন্স নিয়ে ৷ ২১ শতকের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রোনালদো লিমা যেমন জানতেন ঠিক কোথায় বল আসতে চলেছে। তার মতো করেই হ্যালান্ড আয়ত্ব করে নিয়েছেন পজিশন সেন্স। তিনি জানেন তার সতীর্থ কোথায় তার জন্য বলটি বাড়িয়ে দেবেন, বল ডিফ্লেক্ট হয়ে কোথায় আসতে পারে।
তিনি প্রতিপক্ষের পরিকল্পনাও যেন পড়তে জানেন। মিলি সেকেন্ডের মধ্যে তিনি তার জায়গা তৈরি করে নিতে সক্ষম, যেখান থেকে শট চালাতে পারবেন গোলে। প্রতিপক্ষের রক্ষণদূর্গে ছেঁদ করে সতীর্থদের গোল করতেও সাহায্য করেন তিনি।
তার বাম পায়ের শুটিং ক্ষমতা যেন এক আতঙ্ক প্রতিপক্ষ গোলকিপারের ৷ তার সুঠাম দেহ যেন হারিয়ে দিতে পারে যে কোন বডি ট্যাকেল। তিনি তার দূর্বল ডান পা দিয়েও গোল করতে পারদর্শী। মাথা দিয়ে গোল করতেও পিছিয়ে নেই তিনি। এসব কিছুর পাশাপাশি তার গতি যেন তাকে দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। সবকিছু মিলিয়ে তিনি একজন আদর্শ স্ট্রাইকার।
২০২২ এর জুনে তার সাথে ডর্টমুন্ডের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। তিনি পাড়ি জমিয়েছেন ইংল্যান্ডে, ঠিকানা এখন ম্যানচেস্টার সিটি। তিনি হয়ত এই মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চাইবেন। নি:সন্দেহে তিনি চাইবেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের বাজারে তার চাহিদা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে। চাইবেন সিটির হয়ে অমরত্বের সন্ধান করতে।
ইনজুরি সমস্যা কিংবা ঈশ্বরের অনিচ্ছা অথবা তার নিজের খামখেয়ালিতে হারিয়ে যেতে পারেন এই নক্ষত্র। কিন্তু এসব কিছু যদি না ঘটে, এতটুকু এখনই বলা যায় বয়সের সাথে সাথে পরিপক্বতায় বেশ কিছু রেকর্ড হয়ত ভাঙতে চলেছেন তিনি। আমাদের ফুটবল চাহিদা তিনি হয়ত মিটিয়ে যাবেন তার ক্যারিয়ারের শেষ দিন অবধি, সেই প্রত্যাশা ফুটবল ভক্ত হিসেবে আমরা করতেই পারি।