লাল কার্ড, আত্মঘাতী গোল, বোরিং ফুটবল, মিসের উপর মিস; সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রাত দেখেছে কালকে ইউরো। রেকর্ড হয়েছে অনেক। কিছু আনন্দের, কিছু হতাশার, কিছু আবার লজ্জার।
- স্কটল্যান্ড ০-২ চেক রিপাবলিক
প্যাট্রিক শিক!
পুরো ম্যাচকে এই এক নাম দিয়েই বিশ্লেষণ করে ফেলা সম্ভব। কেনই বা নয়? নিজেদের মাটিতে ছড়ি ঘুরিয়েও স্কটল্যান্ড ম্যাচটা হেরেছে এক প্যাট্রিক শিকের কাছেই। ইউরোর চতুর্থ দিনের প্রথম ম্যাচটা নিজের করে নিয়েছেন তিনি।
স্কটল্যান্ড-চেক রিপাবলিক, শক্তিমত্তার দসিক দিয়ে কাছাকাছি থাকায় অনেকেই ভেবেছিল ম্যাচটা বেশ উপভোগ্য হবে। সেটা হয়েছেও। কিন্তু হোম অ্যাডভান্টেজে এগিয়ে ছিল স্কটল্যান্ড। ম্যাচের মাঝেও তা বোঝা গিয়েছে স্পষ্ট। কিন্তু ফাইনাল থার্ডে এসেই খেই হারিয়েছে স্কটিশরা আর অন্যদিকে চেক রিপাবলিক হয়েছে শিকময়।
হ্লাসহোতে ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই আক্রমণের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল স্কটল্যান্ড। কিন্তু মাঝমাঠ থেকে যেই না বল ডি-বক্সের কাছাকাছি যাচ্ছে, সেই খেই হারাচ্ছেন স্ট্রাইকাররা। বিশেষত লিন্ডন ডাইকস। পুরো ম্যাচ তার বাজে পারফরম্যান্স ছিল চোখে লেগে থাকার মত।
অন্যদিকে আস্তে-ধীরে শুরু করা চেকরা, ম্যাচে আক্রমণেও যাচ্ছিল গুছিয়ে। আর সেটার ফল মিলেছে ৪২ মিনিটে। ভ্লাদিমির কুফলের করা ক্রস লাফিয়ে উঠে হেড করলেন শিক। আর তাতেই প্রথম গোল পেয়ে যায় চেক রিপাবলিক। প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-০ গোলে।
তবে কথা বলতে হবে ৫২ মিনিটের গোল নিয়ে। এবারের ইউরোর সেরা গোল হিসেবে নমিনেশন পেলেও ভুল হবে না। স্কটল্যান্ড অল আউট অ্যাটাক শুরু করেছিল দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে। এতটাই যে গোলরক্ষক পর্যন্ত চলে এসেছিলেন মাঝমাঠে। সে সময়ই ভলের উপর কন্ট্রোল হারায় স্কটল্যান্ড।
আর হুট করে বল পেয়ে যান প্যাট্রিক শিক। আর সেখান থেকেই দৌড় শুরু করেন শিক। বল পেয়েই মাঝমাঠ থেকি দূরপাল্লার শট নেন শিক। সামনে এগিয়ে থাকা গোলকিপার ডেভিড মিচেল ছিলেন মাঝমাঠে। দৌড়ে যেতে যেতে বল ততক্ষণে জালে জড়িয়ে গিয়েছে। ৫০ গজ দূর থেকে নেওয়া সে শট রুখতে পারেননি মিচেল।
ইউরোতে এতদূর থেকে নেওয়া কোনো শটে গোল আসেনি আগে কখনও। মোট ৪৯.৭ গজ দূর থেকে নেওয়া শট জড়িয়েছে জালে। আপাত দৃষ্টিতে সেরা গোলের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে আছেন শিক। আর ম্যাচটাও শেষ হয়েছে দুই গোল দিয়ে। যদিও স্কটল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা এত মিস না করলে হয়তো ম্যাচের ফলাফল অন্যরকমও হতে পারতো।
- পোল্যান্ড ১-২ স্লোভাকিয়া
রবার্ট লেওয়ান্ডকির উপরে বেশ ভালো একটা বদনাম আছে। বড় ম্যাচ আসলেই তিনি নিজের ছায়া হয়ে যান। সেই লেওয়ান্ডস্কি আর এই লেওয়ান্ডস্কি, কোনোভাবেই তাকে মেলানো যায় না। লেওয়ান্ডস্কির সামনে ছিল সমালোচনার বেশ ভালো একটা জবাব দেওয়া। তা আর হলো কই? উল্টো আরো জেঁকে বসলো বদনামটা। হেরে বসেছেন স্লোভাকিয়ার কাছে।
এমনকি ম্যাচের শেষ ৩০ মিনিট তাদের খেলতে হয়েছে ১০ জনকে নিয়ে। ৬২ মিনিটে পোল্যান্ড মিডফিল্ডার গ্রেগর্জ ক্রিকোভিয়াক দেখেছেন লাল কার্ড। ম্যাচে ততক্ষণে পিছিয়ে গিয়েছে পোল্যান্ড। ১০ জনের দল নিয়ে আর কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি তারা।
ম্যাচের প্রথম গোল এসেছিল ১৮ মিনিটে। যদিও নামের পাশে স্কোরকার্ডে দেখাচ্ছে গোলটা পোল্যান্ডের গোলকিপার ভয়চেক শেজনি। কিন্তু গোলটা যারা দেখেছেন, তারা অবশ্যই বলবেন, গোলটা স্লোভাকিয়ার রবার্ট ম্যাকেরই। তার নামে গেলে সেরা গোলের তালিকাতেও থাকতে পারতো।
বাঁ দিক থেকে হুট করেই ডিফেন্সে ঢুকে পরেছিলেন ম্যাক। কিন্তু পোলিশ দুই ডিফেন্ডার যেভাবে ঘিরে রেখেছিলেন, তাতে করে নিশ্চিতভাবেই বল বের করার কোনো উপায় নেই। কোত্থেকে কী যযেন হলো, দুই ডিফেন্ডার নিজেদের আবিষ্কার করলেন ম্যাকের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। এতটাই বুদ্ধিমত্তার সামনে দুজনকে ডজ করে কাটিয়ে বল নিয়ে পোছে যান গোলরক্ষকের সামনে।
এরপর তার নেওয়া শট লাগে পোল্যান্ডের পোস্টের নিচের দিকে, ততক্ষণে শট ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শেজনি। বল পোস্টে লেগে ফেরত এসে লাগে শেজনির পিঠে। আর তারপর জালে! ইউরো ইতিহাসে আত্মঘাতী গোল করা প্রথম গোলকিপার বনে গেলেন শেজনি!
শেজনির ইউরোর প্রথম ম্যাচের দূর্ভাগ্যটা এখনও ছাড়েনি। ২০১২ ইউরোর প্রথম ম্যাচে দেখেছিলেন লাল কার্ড, ২০১৬ তে প্রথম ম্যাচেই ইঞ্জুরি আর ২০২০ এ এসে আত্মঘাতী গোল।
দ্বিতীয়ার্ধে নামার ৪৬ সেকেন্ডেই সমতায় ফেরে পোলুয়ান্ড। পোল্যান্ডকে সমতায় ফেরান মিডফিল্ডার ক্যারল লিনেত্তি। দারুণ টিমপ্লে ছিল সে গোল। দ্বিতীয়ার্ধে ভালোই খেলায় ফিরেছিল পোল্যান্ড। কিন্তু ৬২ মিনিটে ক্রিকোভিয়াক লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার পর থেকেই খেই হারায় তারা।
টানা দুই হলুদ কার্ড দেখে এবারের ইউরোর প্রথম লাল কার্ড দেখা খেলোয়াড় হলেন পোল্যান্ডের ক্রিকোভিয়াক। আর সেখান থেকেই খেই হারানো শুরু। আর তার ফলাফল তুলে নেয় স্লোভাকিয়া।
কর্নার থেকে ডিফ্লেক্ট হয়ে ভল চলে আসে বক্সের সামনে থাকা স্ক্রিনিয়ারের কাছে। সেখান থেকে দারুণ ফার্স্ট টাচে বল পাঠিয়ে দেন জালে। আর সেই গোলটাই হয়ে থাকে ম্যাচের ডিসাইডার।
- স্পেন ০-০ সুইডেন
এবারের ইউরোর সবচেয়ে বোরিং ম্যাচের দেখা পেয়ে গিয়েছে বিশ্ব। ম্যাচে একদল রেকর্ড গড়েছে সর্বোচ্চ পাসের, অন্যদল সর্বনিম্ন। আর গোলের দেখা পায়নি কেউই। এমনকি বিরক্তিকর এক ম্যাচ দেখেছে বিশ্ব।
ম্যাচে স্পেন ভালোই খেলছি। প্রথমার্ধে বেশ ভালো পরিমাণ সুযোগ পেয়েছিল স্পেন। কিন্তু স্ট্রাইকার মোরাতার অতিরিক্ত জঘন্য ফিনিশিং ব্যর্থ করেছে সব আক্রমণ। প্রতিটি বলই গিয়ে থেমেছে বাজে ফিনিশিংয়ের জন্য। প্রথমার্ধে মোট ৪১৯ পাস কমপ্লিট করেছে স্পেন। অন্যদিকে সুইডেন দিয়েছে ৫৯টি। ইতিহাসে যতদিন ধরে রেকর্ড কালেক্ট করা হচ্ছে, ততদিন থেকে বিশ্বকাপ ও ইউরো ইতিহাসে এটা রেকর্ড।
দ্বিতীয়ার্ধেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি খেলায়। একই খেলা চলেছে পুরো ম্যাচজুড়ে। আক্রমণে উঠেছে স্পেন, নিজেদের মধ্যে পাসিং করতে করতে। আর সুইডেনের ডিফেন্স তা দিয়েছে আটকে। স্ট্রাইকার বদলিয়েও বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি তাদের।
ম্যাচে ৮৫ পার্সেন্ট পজেশন ছিল স্পেনের। গোলমুখে নিয়েছেন ১৭ শট। পাস কমপ্লিট করেছে ৮৪৯টি। অন্যদিকে সুইডেনের শট ৪টি। পাস মাত্র ৮৯টি। ইউরো ইতিহাসে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি কম পাস দেওয়ার রেকর্ড এটা। অদ্ভুত এক ম্যাচের রেকর্ড তাদের। অসাধারণ ডিফেন্স করে ম্যাচ সেরা হয়েছেন সুইডেনের ভিক্টর লিন্ডেলফ।
সার্জিও রামোসের মতন খেলোয়াড়কে দলের বাইরে রেখে কোনো রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড় ছাড়া ২৪ দলের অদ্ভুত এক দল তৈরি করেছেন লুইস এনরিকে। প্রথম ম্যাচে পয়েন্ট হারয়ে সেই খেসারতই যেন দিতে হলো তাঁকে।