আটলান্টিকের দুই পাড়েই চলছে ফুটবল উৎসব। করোনার দু:স্বপ্নের পরে একই সময়ে শুরু হয়েছে দুই মহাদেশীয় ফুটবল আসর; কোপা আমেরিকা এবং ইউরো। ফুটবলপ্রেমীরা পড়েছেন দারুণ বিপাকে, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন। সাদামাটা চোখে অনেকেই ইউরোর চেয়ে কোপাকে এগিয়ে রাখলেও আসলেই কি তাই? আসুন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার চেষ্টা করি আমরা।
ফুটবলীয় ঐতিহ্যের বিচারে কোপা অবশ্যই এগিয়ে। ১৯১৬ সালে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ নামে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্ট শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছে বেশ আগেই। তবে মাঝে ১৯৫৭-৬৫ টানা আটবছর মাঠে গড়ায়নি এ টুর্নামেন্ট। এবারের কোপা প্রথমে আর্জেন্টিনা এবং কলম্বিয়ায় হবার কথা থাকলেও করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়াতে আয়োজিত হচ্ছে ব্রাজিলে।
প্রতি বছর মহাদেশের বাইরের দুই দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবার সেটা করা হয়নি। তাতেও আলোর ঝলকানি কমেনি, বরং লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ, নেইমার, অ্যালেক্সিস সানচেজ, পাওলো গুয়েরেরোদের অংশগ্রহণে এবারে কোপা তারকাপূর্ণ হয়েছে শুরু থেকেই। কিন্তু আধুনিক সময়ে তারকাদের অংশগ্রহণই কেবল একটা টুর্নামেন্টকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে নাহ।
পূর্বে ফলনির্ভর ফুটবলের চাইতে সুন্দর ফুটবলটাই প্রাধান্য পেত লাতিনের দেশগুলোর কাছে। সবুজ প্রাঙ্গনে বল পায়ে যেন সুরভি ছড়াতেন পেলে-ম্যারাডোনা-গারিঞ্চা-রোনালদিনহো-ঘিঘিয়ারা। জয়-পরাজয়ের কথা না ভেবে মনের আনন্দে খেলতেন তারা। কিন্তু ইদানীংকালে যেন লাতিনের ফুটবল বড্ড বেশি ফলনির্ভর হয়ে গেছে।
জোগো বোনিতো সৌন্দর্য্য হারিয়ে গেছে ব্রাজিলের খেলা থেকে। আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে অনেক দিন থেকেই ফুটবল পরাশক্তির তালিকার বাইরে। তাছাড়া বলিভিয়া-কলম্বিয়া-ইকুয়েডর-পেরু-ভেনেজুয়েলা ফুটবল থেকে পিছিয়ে পড়ায় টুর্নামেন্ট অনেকটাই প্রতিদ্বন্দীতাহীন হয়ে পড়েছে।
কোপার বিগ ফোর ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ের বাইরে সর্বশেষ কোপা জিতেছে কলম্বিয়া, সেটাও ২০০১ সালে। উরুগুয়ে সর্বাধিক ১৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই টুর্নামেন্টে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল জিতেছে যথাক্রমে ১৪ এবং ৯ বার।
অন্যদিকে ইউরোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইউরোকে বলা হয় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ছাড়া বিশ্বকাপ। এবারের আসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউরোপে ভিন্ন ভিন্ন ১১টি শহরে। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্ট শুরুতে ১৬ দল হলেও গত ইউরো থেকে দলসংখ্যা বাড়িয়ে ২৪ করা হয়েছে।
এতে দলগুলোর মাঝে বড়-ছোট ব্যবধান কমে আসছে অনেকাংশে। ফুটবলীয় অবকাঠামো, ছোটবেলা থেকেই প্রপার ফুটবলীয় জ্ঞান, ভালো কোচ ইত্যাদির কারণে শতাব্দীর শুরুতেও ছোট দল আখ্যা পাওয়া দলগুলো এখন তথাকথিত বড় দলগুলোর সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে। গত বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনাল খেলা সেটারই প্রমাণ। এছাড়া সর্বশেষ ১৫ আসরে ১০ টি আলাদা দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ইউরোপিয়ান এই আসরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন মাত্রায় সেটা বুঝাতে এই তথ্যই কেবল যথেষ্ট।
কেবলমাত্র স্পেনের সোনালি প্রজন্ম ইউরো শিরোপা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, ২০০৮ এবং ২০১২ সালে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, কিলিয়ান এমবাপ্পে, টমাস মুলার, লুকা মড্রিচ, রোমেলু লুকাকুদের অংশগ্রহণে এবারে ইউরো তারকাখ্যাতিতেও পিছিয়ে নেই কোনো অংশে।
গোলের খেলা ফুটবলে দর্শকেরা গোল দেখতে পছন্দ করেন। ইউরোর গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই রাউন্ড শেষে মোট গোল হয়েছে ৫৫টি, ম্যাচপ্রতি যা ২.২৯। অন্যদিকে কোপার ১০ ম্যাচে গোল হয়েছে ২১ টি, যার মাঝে কেবল ব্রাজিল একাই দুই ম্যাচে করেছে সাত গোল। লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ, কাভানিদের মতো স্ট্রাইকার থাকা সত্ত্বেও দলগুলো ভুগছে গোল খরায়। গোলহীন থাকার দরুণ দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কোপার এ আসর থেকে।
বর্তমানে কোপার খেলাগুলো কিছুটা বোরিং হলেও ইউরো প্রতিনিয়ত উত্তেজনাপূর্ণ ফুটবল উপহার দিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিতই ছোট দলগুলো বড দলগুলোকে হার উপহার দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ফুটবলীয় নৈপুণ্য কিংবা দর্শক আকর্ষণ সব দিক দিয়েই কোপা আমেরিকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে ইউরো।