বার্বাডোজের ‍দু:সাহসী পুঁচকে

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের অধিকারী; পঞ্চাশের দশকের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান স্যার এভারটন উইকস। যাঁকে মনে করা হয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের একজন।

কিছুটা খর্বাকৃতির ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ সাবেক এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান পরিচিতি পেয়েছিলেন তাঁর ধ্রুপদী ব্যাটিংশৈলীর কারণে। ক্ল্যাসিক টেক্সটবুক ঘরানার টেকনিক ও জমাট ডিফেন্সের সাথে উইকেটের চারপাশে স্ট্রোক খেলার রেঞ্জটাও ছিল বিস্তৃত। প্রখর দৃষ্টিশক্তি, ফুট মুভমেন্টের ক্ষিপ্রতা ও চমৎকার রিস্টপ্লের কারণে যেকোন শটে তাঁর টাইমিং হত নিখুঁত। বিশেষ করে স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর পায়ের কাজ ছিল এককথায় ‘অতুলনীয়’।

যেকোন শট খেলার পূর্বে দ্রুত পজিশনে চলে যেতে পারতেন বলে তাঁর হাতে সবসময় একাধিক স্ট্রোকের অপশন থাকত; এবং সেগুলো সবই আক্রমণাত্মক স্ট্রোক।

‘দ্য টাইমস’ সাময়িকীর মতে, ‘lightly bow-legged, with a wonderful eye, wrists the envy of any batsman, and feet always in the right place to play a shot.’

তাঁর ট্রেডমার্ক শট ছিল তিনটি। ‘পাওয়ারফুল স্কয়ার কাট’, ‘ব্যাকফুট পাঞ্চ’ এবং ‘ওয়েল কন্ট্রোলড মিড উইকেট পুল’।

এই তিনটি শটের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বোধ হয় স্কয়ার কাট। দ্রুতগতির বাউন্সি ট্র‍্যাকে তাঁর এই ‘দু:সাহসিক’ শটটা খুব কাজে দিত।

হাই ব্যাকলিফটের সাথে মাসল পাওয়ার ও চমৎকার ব্যাট স্পিডের কারণে কাভার এবং ‘ভি’ অঞ্চল দিয়ে অনায়াসে ব্যাকফুটে গিয়ে ড্রাইভ খেলতে পারতেন তিনি। টাইমিংয়ের পারফেকশনটা ছিল বিশেষভাবে চোখে পড়ার মত।

তাছাড়া লেগ সাইডের যেকোন শর্ট পিচ ডেলিভারিকে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে চোখের পলকে মিড উইকেট অঞ্চল দিয়ে সীমানাছাড়া করতে তাঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিচি বেনো একবার বলেছিলেন, ‘He (Weekes) was the closest in style to pre-World War II Don Bradman.’

ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকস ছিলেন একজন দারুণ অ্যাথলেটিক ফিল্ডার। ১৯৫০ সালের ইংল্যান্ড সফরের পর থেকে ‘স্পেশালিষ্ট’ স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করলেও ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি ফিল্ডিং করতেন কাভার পয়েন্ট পজিশনে। যথারীতি সেখানেও ফিল্ডার হিসেবে দিয়েছেন দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার পরিচয়।

উইকসের ফিল্ডিং দক্ষতা সম্পর্কে বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক এফ.এল. বেলসন বলেছেন, ‘Weekes possessed the virtues of exceptional quickness of foot and anticipation, natural bent, plus very safe hands.’

উইকসের বাবা ছিলেন ইংলিশ ফুটবল ক্লাব এভারটনের পাঁড় ভক্ত। নিজের সন্তানের নামটাও রেখেছিলেন প্রিয় ক্লাবের নামে; এভারটন। স্যার এভারটন উইকস ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লুজে’র একজন। এই ত্রয়ীর বাকি দুজন হলেন স্যার ফ্রাংক ওরেল আর স্যার ক্লাইড ওয়ালকট।

থ্রি ডব্লুজের কনিষ্ঠতম সদস্য ওয়ালকটের মতে, তিনজনের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান উইকস, সেরা অলরাউন্ডার ওরেল আর সেরা উইকেটরক্ষক তিনি নিজে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটিং। ‘থ্রি ডব্লুজের’ আবির্ভাবের পর সেই ‘দুর্বল’ মিডল অর্ডারই পরিণত হয় বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপে। ওরেল-ওয়ালকট-উইকস ত্রয়ীর গ্রেটনেসের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার নেইল হার্ভে, লিন্ডসে হ্যাসেট; ইংল্যান্ডের ডেনিস কম্পটন, পিটার মে, টম গ্রেভেনি; ভারতের বিজয় হাজারে, পলি উমরিগড়ের মত বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানদেরও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসেই এই তিনজনের মত দাপুটে ও সফল মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান খুব কম এসেছেন।

মূলত নামের আদ্যক্ষরের মিলের কারণেই তাঁরা পরিচিতি পান ‘থ্রি ডব্লুজ‘ হিসেবে। তাঁদের সম্পর্কে প্রায়ই মজা করে একটা কথা বলা হয়ে থাকে, থ্রি ডব্লুজের নামে যদি কখনও একটা ওয়েবসাইট খোলা হত তবে সেটার এড্রেস লেখা হত এভাবে www.www!

এঁদের তিনজনের মধ্যে কেবল নামের মিল (আদ্যক্ষর W) ছাড়াও আরও অনেক মিল ছিল। যেমন – এরা তিনজনই জন্মেছিলেন বারবাডোজের ব্রিজটাউনে, মাত্র ১৭ মাসের ব্যবধানে (১৯২৪ সালের আগস্ট-১৯২৬ সালের জানুয়ারি)। তাঁদের তিনজনেরই পারিবারিক নিবাস ছিল কেনসিংটন ওভাল থেকে মাত্র এক মাইলের মধ্যে। তিনজনেরই অভিষেক হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৪৮ সালে একই সিরিজে। তিনজনই ছিলেন মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটে অবদানের জন্য তিনজনকেই পরবর্তীকালে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পুনর্জাগরণ ঘটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রায় ৮ বছর (১৯৩৯-১৯৪৭) টেস্ট ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল ক্যারিবিয়ানরা।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সিরিজের প্রথম টেস্টেই মূল একাদশে জায়গা করে নেন এভারটন উইকস। একই সিরিজে অভিষিক্ত হন ওয়ালকট-ওরেলরাও।

১৯৪৮ সালের ২১ জানুয়ারি, ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর টেস্ট অভিষেক, ২২ বছর বয়সে। ঐ টেস্টে সর্বমোট ১২ জন ক্রিকেটারের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল।

এভারটন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকট, রবার্ট ক্রিস্টিয়ানি, উইলফ্রেড ফার্গুসন, বার্কলি গ্যাসকিন, জন গডার্ড ও প্রায়র জোন্স – এই ৭ জন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এবং জিম লেকার, মরিস ট্রেমলেট, ডেনিস ব্রুকস, উইনস্টন প্লেস ও জেরাল্ড স্মিথসন – এই ৫ জন ছিলেন ইংল্যান্ডের।

তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ইনিংসে উইকসের সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ৩৫ ও ২৫ রান। ম্যাচটি শেষ হয়েছিল অমীমাংসিতভাবে। পরবর্তী দুই টেস্টেও যখন রান পেলেন না (৫ ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৬) তখন সিরিজের চতুর্থ ও শেষ টেস্টে তাঁকে বাদ দেয়ার চিন্তাভাবনা করছিল ক্যারিবিয়ান টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জর্জ হেডলির আকস্মিক চোটের কারণে সে যাত্রায় টিকে যান তিনি।

জানিয়ে রাখা ভাল, চার নম্বর পজিশনের জন্য জ্যামাইকানদের প্রথম পছন্দ ছিলেন ‘ঘরের ছেলে’ জন হল্ট। তাঁকে বাদ দিয়ে উইকসকে খেলানো হচ্ছে দেখে ব্যাটিংয়ের পুরোটা সময়ই মাঠে উপস্থিত দর্শকদের দুয়োধ্বনি সহ্য করতে হয়েছে উইকসকে। তবে দুয়োধ্বনির জবাবটা তিনি মুখে নয়, বরং দিয়েছিলেন ব্যাট হাতে।

(বাঁ থেকে) ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভারটন উইকস ও ক্লাইড ওয়ালকট।

কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে অনুষ্ঠিত ম্যাচের প্রথম ইনিংসে এভারটনের ব্যাট থেকে আসে মহামূল্যবান ১৪১ রান; যে ইনিংসটি না খেললে হয়ত তাঁর ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যেত। ১৫ বাউন্ডারিতে সাজানো ‘ঝকঝকে পরিপাটি’ সেই ইনিংসের মূল আকর্ষণ ছিল চোখ ধাঁধানো সব ড্রাইভ ও পাঞ্চ শট।

উইকসের অনবদ্য সেঞ্চুরির সুবাদেই ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে ইংল্যান্ডকে হারাতে পেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মত ভারতীয় উপমহাদেশ সফরে আসেন এভারটন উইকস।

সবশেষ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানো উইকস তাঁর পরবর্তী টেস্টটা খেলতে নামেন সাত মাস পর। দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টেই দুর্দান্ত এক শতক (১২৮) হাঁকিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন লম্বা বিরতিতেও তাঁর ব্যাটে বিন্দুমাত্র মরচে ধরে নি!

এরপর বোম্বের ফ্লাট ট্র‍্যাকে হাঁকান আরও একটি সেঞ্চুরি। মাত্র ৬ রানের জন্য মিস করেন ডাবল সেঞ্চুরি (১৯৪)। তৃতীয় টেস্টটা হয়েছিল কলকাতায়। ইডেন গার্ডেনের ঘাসে ভরা ‘সবুজ উইকেটে’ সেদিন শুরু থেকেই দারুণ মুভমেন্ট পাচ্ছিলেন ভারতীয় পেসাররা। ‘বাঙালি’ পেসার শুঁটে ব্যানার্জির জোড়া আঘাতে মাত্র ২৮ রানেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে বসে ক্যারিবীয়রা। ভারতীয় বোলারদের সুইংয়ের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ২৫ বাউন্ডারিতে ১৬২ রানের এক ‘মাস্টারক্লাস’ ইনিংস উপহার দেন এভারটন উইকস। যে ইনিংসটিকে ক্রীড়া সাময়িকী উইজডেন সংজ্ঞায়িত করেছিল এভাবে, ‘Technique flawless and the driving immaculate — both off front foot and back.’

এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও আরেকটি সেঞ্চুরি (১০১) হাঁকিয়ে তিনি ঢুকে যান রেকর্ডবুকের এক অনন্য ক্লাবে! যার সদস্য বলতে তিনি একাই! টেস্ট ইতিহাসে টানা ৫ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানো একমাত্র ব্যাটসম্যান হলেন স্যার এভারটন উইকস। এর আগে টানা ৪ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক ফিঙ্গলটন ও দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালান মেলভিল।

এরপর মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত চতুর্থ টেস্টে সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১০ রান দূরে থাকতে ‘বিতর্কিত’ এক রানআউটের শিকার হন তিনি। ফলে অল্পের জন্য টানা ৬ ইনিংসে সেঞ্চুরির দুর্লভ এক রেকর্ড থেকে বঞ্চিত হন তিনি।

পরদিন একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল, ‘Weekes finally fails — out for 90.’

তবে পরের ইনিংসেই আরেকটি অর্ধশতক (৫৬) হাঁকিয়ে ইতিহাসের ৫ম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা ৭ ইনিংসে ফিফটির বিরল কীর্তির অধিকারী হন উইকস। অনন্য এই রেকর্ডের অংশীদার বাকি সদস্যরা হলেন জ্যাক রাইডার, প্যাটসি হেনড্রেন, জর্জ হেডলি ও অ্যালান মেলভিল। পরবর্তীকালে, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও শিবনারায়ণ চন্দরপলও যোগ দিয়েছেন ক্রিকেটের অভিজাত এই ক্লাবে।

সেবার ভারত সফরের পাঁচ টেস্টের ৭ ইনিংসে ব্যাট করে এভারটনের সংগ্রহ ছিল ৪ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিতে ৭৭৯ রান। ব্যাটিং গড় রীতিমতো অবিশ্বাস্য ১১১.২৯! ব্যাট হাতে ধারাবাহিক ও দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য ১৯৪৯ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটারের’ মর্যাদায় পুরস্কৃত করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর সেবারই প্রথম বিদেশি কোন দলকে আতিথেয়তা দিয়েছিল ভারত। সফরটাকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখতেই এই উদ্যোগ নিয়েছিল তাঁরা।

টেস্টে দ্রুততম ১০০০ রানের রেকর্ডটির মালিক যৌথভাবে স্যার এভারটন উইকস এবং ইংল্যান্ডের হার্বার্ট সাটক্লিফ। এই মাইলফলকটি অতিক্রম করতে উইকস-সাটক্লিফ দুজনেরই লেগেছিল মাত্র ১২ ইনিংস! স্যার ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যানের (১৩) চাইতে এক ইনিংস কম!

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার টেস্টের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম টেস্ট স্বাগতিকরা জিতলেও পরের টেস্টে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ক্যারিবীয়রা। টানা তিন ম্যাচ জিতে নিশ্চিত করেছিল সিরিজ জয়টাও।

ব্যাট হাতে থ্রি ডব্লুজের আধিপত্য আর সনি রামাধিন-আলফ ভ্যালেন্টাইন জুটির স্পিন ভেলকির সৌজন্যে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডকে তাদেরই মাটিতে সিরিজ হারাতে সক্ষম হয় ক্যারিবীয়রা। টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির ২২ বছরে একবারও ‘ইংল্যান্ডের মাটিতে’ ইংল্যান্ডকে হারাতে না পারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এই বিজয় ছিল নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন।

চার ম্যাচের টেস্টের সিরিজে ৩ সেঞ্চুরিসহ ৫৬.৩৩ গড়ে এভারটন উইকস করেছিলেন ৩৩৮ রান। এছাড়া স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে নিয়েছিলেন ১১টি অসাধারণ ক্যাচও। ওই সফরে উইকসের সেরা সাফল্যটা এসেছিল ট্রেন্টব্রিজে; যেখানে ফ্রাঙ্ক ওরেলকে নিয়ে ২৮৩ রানের একটি ম্যাচ উইনিং পার্টনারশিপ গড়েছিলেন তিনি। ওই ম্যাচে উইকসের খেলা ১২৯ রানের অনবদ্য ইনিংসটি ছিল নি:সন্দেহে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস।

সেবারের ইংল্যান্ড সফরে ব্যাট হাতে অমন দাপুটে পারফরম্যন্সের পর ইংলিশ মিডিয়ার পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘No batsman since Bradman has made such an impression on his first English tour as a ruthless compiler of big scores.’

এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে একটি ট্যুর ম্যাচে উইকসের ব্যাট থেকে এসেছিল অপরাজিত ৩০৪* রান যা ইংল্যান্ড সফরে কোন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানের প্রথম ও একমাত্র ফার্স্ট ক্লাস ট্রিপল হান্ড্রেড। ১৯৫০ সালের ইংল্যান্ড সফরকালেই ইংলিশ মিডিয়া তাঁদের তিনজনকে সর্বপ্রথম ‘থ্রি ডব্লুজ’ নামে আখ্যায়িত করে।

ফ্র্যাঙ্ক ওরেল (বামে) ও এভারটন উইকস

ব্যাট হাতে দুরন্ত ও ধারাবাহিক ফর্মের কারণে উইজডেন কর্তৃপক্ষ ১৯৫১ সালের ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ হিসেবে বেছে নিয়েছিল স্যার এভারটন উইকসকে। ১৯৫২-৫৩ মৌসুমে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে উইকসের ব্যাট থেকে এসেছিল সাত শতাধিক রান। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিতে করেছিলেন ৭১৬ রান; অবিশ্বাস্য ১০২.২৯ গড়ে!

ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাও (২০৭) পেয়েছিলেন ওই সিরিজেই, পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে। ২০৭ রানের ওই ইনিংসটি খেলার পথেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বাধিক টেস্ট রানের (আগের রেকর্ডটি ছিল জর্জ হেডলির ২১৯০ রান) মালিক হন এভারটন উইকস।

১৯৫৩-৫৪ মৌসুমে ইংল্যান্ড ও ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজেও ব্যাট হাতে যথারীতি উজ্জ্বল ছিলেন এভারটন উইকস। ইংলিশদের বিপক্ষে ৪ ম্যাচের সিরিজে ৬৯.৫৭ গড়ে করেন ৪৮৭ রান। ৩টা সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি ছিল ১টা। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটাও (২০৬) এসেছিল ওই সিরিজেই।

পোর্ট অব স্পেনে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ফ্রাঙ্ক ওরেলকে (১৬৭) সাথে নিয়ে এভারটন উইকস (২০৬) যোগ করেছিলেন ৩৩৮ রান যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত ৪র্থ উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।

আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি আর ১ ফিফটিসহ ৫৮.৬৩ গড়ে উইকসের ব্যাট থেকে আসে ৪৬৯ রান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেবার ঘরের মাটিতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে বিধ্বস্ত হয় ক্যারিবিয়ানরা। রে লিন্ডওয়াল, কিথ মিলার, বিল জনস্টন, রিচি বেনো, ইয়ান জনসনদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের সামনে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলতে পেরেছিলেন কেবল ‘থ্রি ডব্লুজ’ এর সদস্যরাই।

দুর্দান্ত একটি হোম সিজন কাটানোর পর উইকসের পরের গন্তব্য ছিল নিউজিল্যান্ড সফর। যথারীতি সেখানেও ব্যাট হাতে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি। ডানেডিন (১২৩), ক্রাইস্টচার্চ (১০৩) এবং ওয়েলিংটনে (১৫৬) পরপর তিন ইনিংসে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন ‘টানা’ সেঞ্চুরিকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলা স্যার এভারটন উইকস।

১৯৫৭ সালের ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে আক্রান্ত হন ‘সাইনোসাইটিস’ নামক সংক্রামক ব্যাধিতে। সিরিজ চলাকালীন সর্বমোট পাঁচবার তাঁর নাকে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। এছাড়া একবার ব্যাটিং করতে গিয়ে ডান হাতের একটি আঙুলও ভেঙে গিয়েছিল তাঁর।

অসুস্থতা ও ইনজুরির কারণে পুরো সিরিজটাই তাঁর কেটেছিল হতাশার মধ্য দিয়ে। মাত্র ২৪.৩৭ গড়ে করেছিলেন ১৯৫ রান। তবে সিরিজ চলাকালীন বেশ কয়েকটি মাইলফলকও স্পর্শ করেছিলেন তিনি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে চার হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন এভারটন উইকস (৪২ টেস্টে)। প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে টেস্টে তিন হাজার রানের রেকর্ডটিও উইকসের দখলে (৩১ টেস্টে)। এছাড়াও চতুর্থ ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০,০০০ ফার্স্ট ক্লাস রানের মালিক হয়েছিলেন এই সিরিজেই।

লর্ডসে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। সেই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ৯০ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলেছিলেন উইকস। যে ইনিংস নিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যান ডেনিস কম্পটনের বক্তব্য ছিল, ‘In every respect, it was the innings of a genius.’

স্যার এভারটন উইকসের সবশেষ টেস্ট সেঞ্চুরিটি (১৯৭) এসেছিল ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে, ‘জন্মভূমি’ বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে। পাকিস্তানি লিটল মাস্টার হানিফ মুহম্মদের ৯৭০ মিনিটের স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই ও সাহসিকতার নিদর্শন হিসেবে যে টেস্টটি ইতিহাসে ‘অমর’ হয়ে আছে। সেই সিরিজেও ৬৫.০০ গড়ে তাঁর সাড়ে চারশ’র অধিক (৪৫৫) রান ছিল! পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও ফিফটি (৫১) হাঁকিয়েছিলেন তিনি।

উরু এবং কুঁচকির চোটের কারণে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন এভারটন উইকস। ততদিনে অবশ্য গ্যারি সোবার্স, কনরাড হান্ট, কলি স্মিথ, রোহান কানহাই, সিমুর নার্সদের মত তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানরা দলের হাল ধরার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলেন।

স্যার এভারটন উইকসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যানে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ৪৮ টেস্টের ৮১ ইনিংসে ৫৮.৬১ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৪৪৫৫ রান। ১৫টি টেস্ট সেঞ্চুরির (দুটো ডাবল) পাশে হাফ সেঞ্চুরি আছে ১৯টি। ক্যারিয়ার সেরা ২০৭।

এছাড়া পার্টটাইম লেগ স্পিনে উইকেট নিয়েছেন ১টি আর কাভার পয়েন্ট ও স্লিপে ফিল্ডার হিসেবে নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা ৪৯টি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৫২ ম্যাচের ২৪১ ইনিংসে ৫৫.৩৪ গড়ে উইকসের সংগ্রহ ১২,০১০ রান। ৩৬টি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৫৪টি অর্ধশতক। ক্যারিয়ার সেরা ৩০৪*।

পূর্ণাঙ্গ টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৫৮.৬১ গড় নিয়ে স্যার এভারটন উইকসের অবস্থান সপ্তম। অবসর পরবর্তীকালে বেশ কিছু প্রদর্শনী ও চ্যারিটি ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেন এভারটন উইকস। ষাটের দশকের শুরুতে রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) সফরে গিয়ে একবার বর্ণবৈষম্যের শিকার হন তিনি। একটি শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয় আইনমতে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’দের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় তাঁকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হয় নি। এমনকি বুলাওয়ে একাদশের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচের ভেন্যু পর্যন্ত পাল্টাতে হয়েছিল!

এ ঘটনায় যারপরনাই মর্মাহত এভারটন উইকস ও সতীর্থ রোহান কানহাই সফরটি বাতিলের হুমকি দিলে রোডেশিয়ান সরকারের কর্মকর্তারা তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।

ক্রিকেট ছাড়ার পর ‘বার্বাডোজ ডেইলি’ নামক একটি পত্রিকায় কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন এভারটন উইকস। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন সাবেক ধারাভাষ্যকার ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ টনি কোজিয়ার।

১৯৭৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে কানাডা দলের কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে নিযুক্ত হন আইসিসি মনোনীত ম্যাচ রেফারি হিসেবে। ৪টি টেস্ট ও ৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ‘রেফারি’র ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে।

ক্রিকেটে অবদানের জন্য বেশ কয়েকটি সম্মানসূচক পদবী লাভ করেন স্যার এভারটন উইকস। তার মধ্যে রয়েছে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (OBE), ‘বার্বাডোজ গোল্ড ক্রাউন অব মেরিট’ (GCM) এবং ১৯৯৫ সালে প্রাপ্ত সম্মানসূচক ‘নাইটহুড’ উপাধি।

‘ওরেল-ওয়ালকট-উইকস’ ত্রয়ীর সম্মানার্থে ২০০৭ সালে বার্বাডোজ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কেনসিংটন ওভালের একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয় ‘থ্রি ডব্লুজ’ স্ট্যান্ড। ২০০৯ সালে আইসিসি ‘হল অব ফেমে’র একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে স্যার এভারটন উইকসকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এভারটন উইকসের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট জীবনের অধ্যায়সমূহ নিয়ে একটা বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যেই। উইকসের নিজের হাতেই লেখা বইটির নাম ‘Mastering the Craft: Ten Years o Weekes 1948-1958.’

তিন ডব্লু’র দুজন ফ্রাঙ্ক ওরেল আর ক্লাইড ওয়ালকট পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন অনেক আগেই, জীবনের ইনিংসে টিকে ছিলেন কেবল স্যার এভারটন উইকই। তবে, তিনিও চলে গেছেন ২০২০ সালে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link