বেশ কিছুকাল হলো, এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘আইন’ হয়ে গেছে। উইকেটে দুই বাহাতি থাকলে বাহাতি বোলার বা লেগস্পিনারকে আক্রমণে আনা হয় না। এর ফলে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে অনেক ম্যাচে বাজে অবস্থায়ও পড়েছে। সর্বশেষ পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দুই বাহাতি উইকেটে থাকায় ১৯ ওভারের মধ্যে বল দেওয়া হয়নি লেগস্পিনার আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে।
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ এবং দেশের প্রবীণ কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সাথে। তিনি ব্যাপারটা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
বাঁহাতি ব্যাটসম্যান উইকেটে থাকলে লেগস্পিনার বা বাঁহাতি বোলার আক্রমণে আসবেন না। ফাহিম ভাই, এটা কী ক্রিকেটের নিয়ম?
আমি বুঝি, এটা যোগ্যতা ঢাকার চেষ্টা। আমার মনে হয় যে একজন বোলার যদি ডানহাতি, বাঁহাতি হিসাব করে বল করে তাহলে আমার কাছে মনে হয় না সে আন্তর্জাতিক মাপের বোলার। অকেশনাল বোলারদের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। কিন্তু একদম বোলার হিসাবে যারা দলে খেলে তাদের কাছে ডানহাতি বাঁ-হাতি কোন ফ্যাক্টর হতে পারে না। একটা দলে যদি এমন দু’জন বোলার থাকে যারা ডানহাতি বা বাঁ-হাতি হলে সমস্যায় পড়ে যায় এবং তাদের বোলিংয়ের সময় যদি ঐরকম ব্যাটসম্যান থাকে তাঁর মানে এরা কী বোলিং করবে না? তিন বোলার নিয়ে কী খেলবে তাঁরা? এরকম ক্ষেত্রে কেউ পিছিয়ে আসলে বুঝতে হবে সে পরিপূর্ণ বোলার না।
লেগ স্পিনাররা বাহাতিদের আউট করছে বা রান আটকে রাখছে, এটা তো বিরল কোনো দৃশ্য নয়?
অবশ্যই না। আমাদের আফিফ যে এতো ভালো খেলছিল গতকাল (প্রথম টি-টোয়েন্টিতে), সে কেমন করে আউট হলো? সে লেগ স্পিনারের কাছে আউট হলো। সে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান না? অন্যান্য দেশের বোলারদের ক্ষেত্রে যদি আমরা দেখি ওরা কিন্তু বাঁ-হাতি ডানহাতি দেখে না। সবাই কে বল করে। বেছে বেছে বল করার কোন সুযোগই নাই।
এমনিতে ক্রিকেটটিং পয়েন্ট অব ভিউতে যদি বলেন, বাহাতি ব্যাটসম্যানরা আসলে বাহাতি বোলার বা লেগস্পিনারের বিপক্ষে কতটা সুবিধা পায়?
না, জিনিসটা হলো ব্যাটসম্যানের অ্যাওয়ে বল যদি যায়, তাহলে ব্যাটসম্যানের জন্য কিছুটা কঠিন হয়। সেটাই চায় বোলাররা। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বাহাতি বোলার ওই সুবিধা পায় না। এখন কথা হলো, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রেও তো ডানহাতি বোলাররা এই সুবিধা পায় না। আসলে আপনার হাতে তো বিকল্প ডেলিভারি থাকবে। আপনি তো সবসময় অর্থোডক্স ডেলিভারিটাই করবেন না। এখন তো অনেক ধরণের নতুন নতুন আইডিয়া আসছে। ফলে বাঁ-হাতি ডানহাতি সমান ভাবে এফেক্টিভ হতে পারে। রবীন্দ্র জাদেজা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বোলিং করে না? ও তো বাঁ-হাতি বোলার, ও বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বোলিং করে। দেখলেই বোঝা যাবে ও কত ভালো ভাবে ওদের আটকে রাখে, উইকেট নেয়। বোলারদের অনেক ক্রিয়েটিভ হতে হবে। তাঁর কী করার আছে সেই জিনিসটা বের করাই তো বোলারের কাজ। অনেক বোলারই বল করছে, তাঁরা ডানহাতি বাঁ-হাতি দেখছে না। এবং তাঁরা সফল।
আপনি কোচ হলে আপনার দলের অধিনায়ককে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিতেন যে, দুই বাহাতি থাকলে আমি লেগস্পিনার আনবো না?
প্রশ্নই আসে না এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আর বোলারের অবস্থা যদি এরকম হয় তাহলে ঐ বোলারকে আমি খেলাবো বলে তো মনে হয় না। আমি যদি পাঁচ জন বোলারকে নিয়েই খেলি আমার লক্ষ্য থাকবে তাদের দিয়েই বিশ ওভার করানোর। আমি যদি এক জনকে বল করাতে না পারি তাঁর মানে আমি দশ জনকে নিয়ে খেলছি। এরকম একটা ম্যাচে দশ জন খেলে তো সম্ভব না। আমরা যদি গতকালের ম্যাচটা ধরি, আমরা কিন্তু পাঁচ জন স্পেশালিস্ট বোলার নিয়ে খেলেছি বেশ রিস্ক নিয়েই। আমাদের ব্যাটিংটা একটু দূর্বল হয়েছে কিন্তু। অথচ ঐ রিস্ক নেওয়াটা আমার কোন কাজেই লাগলো না। এরকমই যদি হয় তাহলে আমরা একটা ব্যাটসম্যান নিতে পারতাম, এই লেগ স্পিনারকে না নিয়ে। তাহলে আমাদের ব্যাটসম্যান বাড়তো। পরে আমরা মাঠে যেটা করলাম, তাতে ঐ রিস্কটা কোন কাজেই লাগলো না। এটা আমার কাছে মনেই হয়না যে, একজন বোলারকে ডানহাতি বাঁ-হাতি বিচার করে বোলিং করতে হবে। দুই ধরণের ব্যাটসম্যানদের বোলিং করার যোগ্যতা থাকবে না তাঁর এটা হতেই পারে না।
সাকিব নিজেও কিন্তু বাহাতি দু জন ব্যাটসম্যান থাকলে বোলিংয়ে আসতে চায় না। এটা কেনো হয়?
একটা হতে পারে যে, বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ব্যাট করছে, আমার ডানহাতি বোলারও আছে, বাঁ-হাতি বোলারও আছে; এরকম সময় আমি ডানহাতিকে এখন কাজে লাগালাম। অপশন যদি থাকে। মানে, একই মানের দু জন বোলার থাকলে এ সময় হয়তো বাহাতিকে না পাঠিয়ে আমি ডানহাতিকে পাঠাবো। কিন্তু এটা এমন না যে জোর করে বাহাতি বোলারকে বসিয়ে রাখতে হবে। অপশন বেশি থাকলে এটা করা ঠিক আছে। আমাদের সামনে এখন প্রচুর উদাহরণ আছে। মঈন আলী ওপেন করছে টি-টোয়েন্টিতে। এক দিকে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান, আরেক দিকে ডানহাতি ব্যাটসম্যান; সে সমানে বোলিং করছে পাওয়ার প্লেতে।
আসলে আমাদের অধিনায়কদের মাথায় এটা এভাবে গেঁথে গেলো কেনো? রিয়াদ একা নন; সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি; সবাই এই কাজ করেন।
কিভাবে এটা হলো, জানি না। তবে আমার মনে হয় এটা একটা মানসিক দূর্বলতা। এবং এটা একটা ভুল বার্তাও দেয় সবাইকে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটকেও ভুল বার্তা দেয়। সবাই কিন্তু এখন নিজেদের এভাবেই গড়ে তুলবে। আমি যদি ডানহাতি বোলার হিসাবে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে খুব ভালো নাও করি এটা আমার কোন দোষের ব্যাপার না। কিন্তু আমাকে বলটা করার সাহস রাখতে হবে। আমাকে একটা পথ বের করতেই হবে। ওরা করে, ওরা করে। আমরা ভুল বার্তাটা দিচ্ছি কিন্তু। এখন তরুণ বাহাতি স্পিনাররা বাহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বলই করতে চাইবে না। তারা এটা জাতীয় দল দেখে শিখছে। এটা তরুণদের জন্য বাজে একটা বার্তা দিচ্ছে।
এটা কী আমাদের প্রতিপক্ষের কাছেও একটু দুর্বল করে দেয় না খেলা শুরুর আগেই?
অবশ্যই। এর ফলে প্রতিপক্ষেআগে থেকেই জানে যে, এটা ওদের দুর্বলতা। আমরা দু জন বাহাতি পাঠাতে পারলে ওরা আর বাঁ-হাতি স্পিনারকে বল দেবে না। এই কৌশল সকলে বুঝে যাওয়া মানে, আপনার আগে থেকেই এক্সপোজ হয়ে যাওয়া।