বিরাট কোহলিকে প্রথম দেখি যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে। দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে লো স্কোরিং ম্যাচ। প্রতি মুহূর্তেই কিছু না কিছু করছেন। এক্সপ্রেশন দিচ্ছেন, উজ্জীবিত করছেন, বোলারের সঙ্গে কথা বলছেন। তবে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল শেষের আগ মুহূর্তটা। দুই বল আগে ভারতের জয় নিশ্চিত হলেও সবাইকে ঠোঁটে আঙুল রেখে শান্ত থাকার ইঙ্গিত দেন। ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেলিব্রেশন নয়।
অত অল্প বয়সী একজনের এমন পরিণত বোধে চমৎকৃত হয়েছিলাম, এবং তাঁর অধিনায়কত্বের মুগ্ধ দর্শকও বনে গিয়েছিলাম। নাম ধাম জানার অত বালাই ছিল না, পরে কি করলেন না করলেন সে খোঁজও কে রাখে! কিন্তু কৈশোর বয়সের ঐ এক চিলতে মুগ্ধতা এখনো বড় আদরে লালন করে যাচ্ছি।
বছর কয়েকের মধ্যে ভারতের মূল দলের হয়েও আলো ছড়াতে শুরু করলেন। নেতৃত্ব পাওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মহেন্দ্র সিং ধোনির কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অভিষেকেই জোড়া সেঞ্চুরি। একরোখার মতো ড্রয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে ৩৬৪ রানের পাহাড় চূড়া ডিঙিয়ে জয়ের পথে ছুটলেন। পরিসংখ্যান বলবে, সে ম্যাচ হেরে গিয়েছিল ভারত। আসলে কিন্তু কোহলির দুঃসাহসিক বিরাট-ভাবনার পরাজয় হয় না কোনোকালেই।
ভারত তখন পালাবদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তরুণ দলের দায়িত্ব কাঁধে তাঁর। রঙিন ক্রিকেটের নেতৃত্বও পেলেন বছর দেড়েকের মাথায়। ভারতের ক্রিকেট দল হয়ে উঠল কোহলির দল। তিনি শুধু ক্রিকেট দলের নেতা নন, যেন সর্বভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনের নেতা। ভারতের অন্য সব খেলাও যেন পিছিয়ে না থাকে তাই কত উদ্যোগ তাঁর। খেলার মাঠে যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ সর্বগ্রাসী, বুভুক্ষু ও আগ্রাসী। কিন্তু মাঠের বাইরেই অন্যরকম একজন।
যেন রিঙয়ের ভেতর জাত বক্সার, রিঙের বাইরে নিপাট ভদ্রলোক। বুক দিয়ে আগলে রাখেন সতীর্থদের। এত আক্রমণাত্মক অধিনায়ক হওয়ার পরও ক্যাচ মিস বা খেইহীন বোলিংয়ের জন্য কোনো সতীর্থকে চোটপাট করেছেন, তেমন ঘটনা নেই বললেই চলে।
পরীক্ষীত সহযোদ্ধাদের বরাবর সমর্থন করে গেছেন। মোহাম্মদ সিরাজ, উমেশ যাদবদের মতো তরুণদের পিঠ চাপড়ে গেছেন প্রতিনিয়ত। বিনিময়ে পেয়েছেন সতীর্থদের বুক ভরা ভালোবাসা। একজন নেতা এরচেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে? কমান্ডারের জন্য সৈন্যদল জানবাজি রেখে লড়তে প্রস্তুত – এর চেয়েও বড় সফলতা আর কী থাকে?
তবু একদল তাঁকে বলবে ট্রফিহীন। তাঁকে বলবে অযোগ্য নেতা। দলের উপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে দেখা হবে খেলো চোখে। তাঁর প্রতি সহকর্মীদের কলজে ছেঁড়া নিবেদন আমলেও নেয়া হবে না। মাঠের কোহলির আগ্রাসন দিয়ে বিচার হবেন ব্যক্তি কোহলি। বলা হবে তিনি উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল। তাঁর ক্রিকেট উচ্চাভিলাষের স্বীকৃতি মিলবে না। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তাঁর অধীনে ভারতীয় ক্রিকেটে যে নতুন ব্র্যান্ড জন্ম নিয়েছে, তা অনেকের চোখেই পড়বে না। ব্যক্তি কোহলির বিনয়টাও দেখে কয়জন? ক্রিকেট নিয়ে তাঁর প্যাশন, আন্তরিকতা, ভালোবাসা বুঝেই বা কয়জন?
সদ্য কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখা কোহলির নেতৃত্বে মুগ্ধ ছিলাম। মুগ্ধ ছিলাম তাঁর পরিণত বয়সের অধিনায়কত্বেও। ক্রিকেটের মূখপাত্রের মতো ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন তিনি। শুনতে হয় মুগ্ধতা নিয়ে। তাঁর পক্ষে ভাগ্য খুব একটা ছিল না। ক্রিকেট অধিনায়কত্ব নব্বই ভাগ স্কিল ও দশ ভাগ ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ঐ দশভাগ যদি না থাকে তাহলে বাকি নব্বই ভাগ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। বহুকাল আগে মাইক ব্রিয়ারলি বলেছিলেন।
কোহলি বেশিরভাগ সময় এই দশভাগ পাশে পাননি। অধিনায়ক কোহলির মুগ্ধ সমর্থক হিসেবে বহু আগে একটা আশঙ্কা ছিল। হয়তো তিনি কোনো ট্রফি জিতবেন না। বছর ধরে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলবে তাঁর দল। কিন্তু মূল আসরে পাবেন লবডঙ্কা। ধোনীর এই ভাগ্যটা ছিল অতিমাত্রায়। উদাহরণ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ফাখার জামানের নো বলে বেঁচে যাওয়ার কথা বলা যায়।
এই সময়ে এশিয়া কাপ ছাড়াও আরো কিছু টুর্নামেন্ট জিতলেও সেসবের নেতৃত্বে কোহলি ছিলেন না। রুবেলের ওভার থেকে কার্তিকের ২২ রান নেয়ার ঘটনা কোহলির ক্যাপ্টেন্সিতে হয় না। কোহলি অনন্য এই কারণেই। সৌভাগ্যের ছোঁয়া সেভাবে না পেলেও তাঁর অর্জন চোখ কচলে উঠার মতো। একটু যদি ভাগ্যটা তাঁর পক্ষে হাসত, এই পরিসংখ্যানই তাঁর হয়ে সাফাই গাইতে মুখে ফেনা তুলত।
ক্রিকেট নিয়ে আমার অনুমান অনেক সময়ই ভুল হয়। স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে মিলে যায়, ঝড়ে বক মরার মতো। কোহলির ক্যাপ্টেন্সি আমাকে হতাশ করেনি। তবে খুব করে চেয়েছিলাম পূর্বানুমান মিথ্যা হোক। একটা ট্রফি অন্তত জিতুন। প্রতি আইপিএলে আমি তাঁর দলের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করতাম। খুব কাছে গিয়েও হয়নি। প্রায়শই এইরকম হয়েছে। এখন অবশ্য ঝাড়া হাত পা।
নেতৃত্বের দায় নেই, যদিও ক্যাপ্টেন্সি বরাবর উপভোগ্য ছিল তাঁর কাছে। আমরাও তাঁর পাগলাটে এক্সপ্রেশন উপভোগ করেছি। জেদী ও একগুঁয়ে তিনি। ৭০ সেঞ্চুরিতে আটকে গেছেন বহুদিন। সাঈদ আনোয়ারকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। আচমকা সতেরো সেঞ্চুরিতে আটকে গিয়েছিলেন। বহুকাল পর নিরানব্বই বিশ্বকাপে ব্যাক টু ব্যাক করার পর ২০০১-এ আবার পরপর সেঞ্চুরি।
আশা করি বিরাটের ক্ষেত্রে তা হবে না। একশোটা সেঞ্চুরি পাওয়ার ন্যুনতম সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন তিনিই। শৃঙ্গ ছোঁয়া না হোক, কাছাকাছি অন্তত তো যাবেন। জেদের বশে রানবন্যাও অসম্ভব না। প্রত্যেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার শেষের আগে রাঙিয়ে যান। শচীনের ২০০৮ থেকে ২০১১ সময়টা, সাঙ্গাকারার শেষটা, ইউনিস খান সহ আরো কত উদাহরণ। উল্টো গল্পও আছে। তবে কোহলির শেষ এত সহসা হবে না আশা করি। তিনি জাত ফাইটার। জন্ম লড়াকু। বহু হিসেব নিকেশ চুকানোর আছে।
চ্যাম্প, আমাকে আরো বহুবার মুগ্ধ করবেন। বারবার মুগ্ধ করবেন। আমি আরো বহুকাল বিরাট কোহলিতে মুগ্ধ হতে চাই।