এক জন ক্রিকেট ভিলেন বা বিপ্লবী!

আজ শিমলা তো কাল নৈনিতাল; ছেলেটাকে কোথাও রেখে শান্তি পাচ্ছিলেন না বাবা।

স্কুল পালায়, মারামারি করে। একটার পর একটা স্কুল বদলাতে হয়। প্রতিটা স্কুল থেকেই ছেলের নামে অভিযোগ শুনতে শুনতে কান্ত হয়ে যান শিল্পপতি বাবা।

শেষ ভরসা হিসেবে ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রে; ওখানে যদি মানুষ হয়। কিসের মানুষ হওয়া! বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ছেলের আরও অনেক গুণপনা বেরোয়। মাদকসেবন, মাদক পাচার, অপহরণ, হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র আক্রমণ; এমন সব অভিযোগে দফায় দফায় গ্রেপ্তার ছেলে। সব মিলিয়ে এক ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সুশীল ভাবমূর্তির বাবার জীবন।

এমন গুনী ছেলের গল্প খেলার পাতায় কেন?

কারণ, এ ছেলেটি আজকের লোলিত কুমার মোদি। যাঁর যন্ত্রণা, পরিবারের গন্ডি ছাড়িয়ে ক্রিকেটে এসে পড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই মানুষটির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তাবৎ ক্রিকেট দুনিয়া!

ক্রিকেটের শুদ্ধতার দিক থেকে দেখলে, তার ইতিহাসের সেরা কলঙ্কগুলোর একটা হলো এই লোলিত মোদি। কিন্তু অন্যদিক থেকে দেখলে এই মানুষটি ক্রিকেটের একটা বিপ্লবের শুরু করেছেন। আজকে পৃথিবী জুড়ে যে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দাপট, টি-টোয়েন্টি লিগের উত্থান; এর স্বীকৃত সূচনা হয়েছিলো লোলিত মোদির হাত ধরে। আইপিএলের এই প্রাক্কালে তাই স্মরণ করা যাক এই টুর্নামেন্টটির জনককে।

২০০৫ সালের আগে একেবারেই ক্রিকেট-বিবর্জিত লোলিত মোদি গত পাঁচ বছরে শুধু ভারতের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাবে তিনি দুনিয়ার অন্যতম মতাধর ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। টাইমস অব ইন্ডিয়ার জরিপে একসময় তিনি ভারতের ৩০তম ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন! ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) দিয়ে এক সুতোয় বেঁধে ফেলেছিলেন তিন ‘সি’কে: ক্রিকেট, সিনেমা ও ক্রাইম!

মোদিনগরের প্রতিষ্ঠাতা রাজবাহাদুর গুজারমাল মোদির বংশে জন্ম লোলিত মোদির। জন্মেই দেখেছেন মোদি এন্টারপ্রাইজ নামে এক সাম্রাজ্যের মালিক বাবা কৃষাণ কুমার মোদি। স্কুল ও কলেজজীবনে ভারতে যেসব কীর্তি করেছেন মোদি, তার কিছুটা তো লেখার শুরুতেই জেনেছেন।

মোদিকে সভ্য করে তোলার উদ্দেশ্যেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবস্থায়, ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ৪০০ গ্রাম কোকেন পাচারের অপরাধে মোদিকে হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশ। অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানোরও অভিযোগ দায়ের করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। আদালত তাঁকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দিলেও মাসখানেকের মধ্যে আবার গ্রেপ্তার হন মোদি।

২ এপ্রিল, ১৯৮৫ ডিউক ইউনিভার্সিটিরই এক ছাত্রসহ মোদিকে গ্রেপ্তার করা হয় মারামারি ও অপহরণের অভিযোগে। এবার আদালত তাঁকে দুই বছরের স্থগিত কারাদণ্ড দেন। পরবর্তীকালে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে পত্রিকাগুলো এসব পুরোনো অভিযোগ সামনে আনলে সবই অবশ্য অস্বীকার করেন মোদি।

কিন্তু পত্রিকাওয়ালারাও কম যান না। তাঁরা দ্য লন্ডন টাইমস-এর ১৯৮৫ সালের ১ মার্চের সংখ্যাটি খুঁজে বের করেছেন আর্কাইভ থেকে। সেদিনকার টাইমস-এ ‘মাদক ক্রেতাকে বন্দুকের মুখে ছিনতাই: ডিউক ছাত্র ডাকাতির অভিযোগে অভিযুক্ত’ শিরোনামে একটি সংবাদে লেখা হয়েছিল,‘ ডিউকের ছাত্র, ভারতের নয়াদিল্লির লোলিত কুমার মোদিকে মঙ্গলবার রাতে কোকেন পাচার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

শেষ পর্যন্ত শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে ১৯৮৬ সালে ভারতে ফিরে আসেন মোদি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে ‘মোদি এন্টারপ্রাইজ’-এর নানা ব্যবসায়িক কাজে।

এ সময়ে মোটামুটি ‘নিরুপদ্রব’ জীবন কাটান মোদি। অবশ্য নিরুপদ্রব মানে, একেবারে শান্তশিষ্ট সুবোধ বালকটি নয়। ১৯৯৭ সালে চুক্তিভঙ্গের দায়ে মোদিকে আদালতে তুলেছিল ইএসপিএন। এর মধ্যে দারুণ আলোচনায় আসেন এক দিওয়ালির রাতে এক কোটি টাকারও বেশি জুয়ায় উড়িয়ে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়ে। কিছুদিন পর আবার আদালতে হাজির হতে হয় আরব আমিরাতে মাদক পাচারের অভিযোগে; এবার তদন্তের মুখোমুখি হয়ে পার পেয়েছিলেন ক্ষমতাধর বাবার কারণে। এর প্রত্যেকটা ঘটনাই তখন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যম কোনোদিনই অনুমান করতে পারেনি, এই লোকটিই একদিন ক্রিকেটের কারণে খবর হবেন।

স্কুল ও কলেজ-জীবনে মোদি খেলাধুলার কিছুটা খোঁজখবর রাখতেন। কিন্তু ক্রিকেট তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল না। তাঁর এক কলেজ বন্ধুর স্মৃতিচারণা, ‘আমি যত দূর মনে করতে পারি, পেলে আর বিয়ন বোর্গ ওর ক্রীড়া-নায়ক ছিলেন; কোনো ক্রিকেট তারকা নয়।’

সেই মোদিই ১৯৯৯ সালে হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে গেলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন, নতুন একটা স্টেডিয়াম গড়ে দেওয়ার। তবে তার আগেই ২০০০ সালে এই অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁকে বের করে দেন প্রদেশের নতুন মুখ্যমন্ত্রী ।

ততদিনে ক্রিকেটের নেশা ধরে গেছে মোদির। নামটাকে সামান্য বদলে ‘লোলিত কুমার’ করে তিনি নাগোর জেলার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে (আরসিএ)।

এরপর বন্ধুপ্রতিম বসুন্ধরা রাজে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় মোদি রাতারাতি আরসিএ সভাপতি হিসেবে বিসিসিআইয়ের সদস্য হয়ে যান।

বিসিসিআইয়ের সদস্য হওয়ার পরই তৎকালীন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়াকে ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ’ (ঠিকই পড়েছেন) নামে সীমিত ওভারের একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রস্তাব দেন, যেখানে বিদেশিরাও খেলবেন। ‘অর্থলিপ্সু’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ডালমিয়া এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি।

এবার মোদি নতুন ‘খেলা’ শুরু করেন। কংগ্রেসনেতা শারদ পাওয়ারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ডালমিয়াকে বোর্ড থেকে সরানোর উদ্যোগ নেন। এ কাজে সাফল্যের পুরস্কারও পান মোদি। পেয়ে যান বিসিসিআইর সহ-সভাপতির পদ। পাস হয়ে যায় মোদির ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ পরিকল্পনা; কারণ ততদিনে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) নামে একটি টুর্নামেন্ট মাথা তুলে ফেলেছে।

এসেল গ্রুপের মালিক সুভাষ চন্দ্রের আইসিএলকে জৌলুশহীন করা ও বিপুল টাকা কামাইয়ের জোড়া লক্ষ নিয়ে যাত্রা শুরু করে আইপিএল। ক্রিকেট দুনিয়ায় শুরু হয় ‘লোলিত মোদি যুগ’।

আইপিএল শুধু বিসিসিআইকে নয়, দুনিয়ার অনেক ক্রিকেটারকেই টাকার পাহাড়ে চড়িয়ে দিয়েছে। আইপিএলের অর্থনৈতিক দাপটে মোদিরা অগ্রাহ্য করতে শুরু করেন ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রকেও। ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় আইপিএলকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যান মোদি। এই ঘটনায় স্পষ্ট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ভারতের তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম।

সরকারের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের পরোক্ষ ফলে মোদি ২০০৯ সালে হেরে যান আরসিএ নির্বাচনে। বিসিসিআইতে তাঁর পদই শঙ্কার মধ্যে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আইএস বিন্দ্রার আশীর্বাদে মোদি পাঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি হয়ে যান। ফলে টিকে যায় তাঁর বিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি পদ।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না মোদির। আবারও কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে তোলেন আইপিএল চলার সময়। টুইটার-এ তিনি অভিযোগ করেন, আইপিএলের নতুন দল কোচির মালিকানা বান্ধবীকে পাইয়ে দিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর। এ অভিযোগের জের ধরে থারুরকে পদত্যাগও করতে হয়েছে।

এতদিনে মোদির সঙ্গে কংগ্রেস সরকারের বিরোধটা গিয়ে চরমে ওঠে। আগেই আইপিএল দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে কংগ্রেসকে সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন মোদি। সে সময় চিদাম্বরমরা মোদিকে সোজা জেলে ঢুকিয়ে দিতে চাইলেও বেচে গেছেন তিনি শরদ পাওয়ারের আশীর্বাদে। আর এবারের গন্ডগোলে শরদ পাওয়ার, নিরঞ্জন শাহরা মোদির পাশে আর দাড়ালেন না। বরং মোদির বিরুদ্ধে তারাই ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেন।

বিসিসিআই সহ-সভাপতির পদ থেকে তাঁর বহিষ্কৃত হওয়াটা এই বিরোধেরই ফল। এতে করে তাঁর আইপিএল চেয়ারম্যান পদটা আপনা-আপনিই হারিয়ে যায়। একটা পর একটা অভিযোগ আসতে শুরু করে মোদির নামে। দল কেনাবেচায় কারচুপি, বেনামে তিনটি আইপিএল দলের মালিকানা নেওয়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাজির সিন্ডিকেট পরিচালনা, প্রচারস্বত্বে অস্বচ্ছতা, অবৈধ লেনদেন, আয়করে ফাঁকি, ম্যাচ পাতানোর অভিযোগের ভারে এখন নুয়ে পড়েন মোদি।

এসব কিছু থেকে বাঁচতে পালিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। যদিও ইংল্যান্ডে গিয়ে দাবি করেন, তিনি ‘পালননি’।

তবে এটাও বলেন, আপাতত দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই তার। কারণ ভালো করেই জানেন, হাতকড়া নিয়ে তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একটার পর একটা পুরোনো মামলা জীবিত করে তোলা হয়েছে। একেই বোধহয় ‘ন্যাচারাল পানিশমেন্ট’ বলে!

লোলিত মোদি এখন অনেকটাই দৃশ্য থেকে হারিয়ে গেছেন। ক্রিকেটে আর তার কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। মাঝে বিভিন্ন দেশে একটা বিদ্রোহি লিগ চালুর জন্য বেনামে চেষ্টা করেছিলেন। কাজ হয়নি। এখন আর কোনো খবরেই তার নাম নেই।

লোলিত মোদি দৃশ্যত হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে আইপিএল।

এখন ক্রিকেটের বিচার, সে কী লোলিত মোদিকে বিপ্লবী বলবে, নাকি ভিলেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link