বুড়ো ব্যাটের আভিজাত্য

মুখভর্তি দাঁড়ি। তাঁর মাঝে লুকিয়ে থাকে আভিজাত্য। টেস্ট ক্রিকেটের আভিজাত্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তাঁর দাঁড়ির আভিজাত্য। অদ্ভুত ব্যাটিং স্ট্যান্টে বিচলিত করেন প্রতিপক্ষের বোলারদের। বলছিলাম, করাচি টেস্টের নায়ক ফাওয়াদ আলমের কথা। শিবনারায়ণ চন্দরপলের ব্যাটিং শৈলীর সাথে অন্যেরা তার মিল খুঁজে পেলেও, আমি বরঞ্চ খুঁজে পেয়েছি বৈচিত্র্য।

বোলার যখন রান-আপ শুরুর প্রস্তুতি নেন, তখন ফাওয়াদ বাম পা দেন লেগ স্ট্যাম্পে আর ডান পা রাখেন লেগ সাইডের ওয়াইড লাইনের খানিকটা আগে। দেখলে মনে হবে বিপরীত পাশ থেকে তেড়ে আসা কোনো বোলার কে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বোলার রানিং শুরু করলে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যান সোজা হয়ে। বল পিচ করার আগেই, ডান পায়ের সহায়তায় স্ট্যাম্প গার্ড করে নেন সহজেই। বোলারের কাছে সুবিধাজনক মনে হলেও, ফাওয়াদকে পরাজিত করা হয়ে দাঁড়ায় দুস্কর ব্যাপার।

ঘরের মাঠে প্রোটিয়া বোলারদের ব্যাটিং স্ট্যান্টে অসহ্য করে আদায় করে নেন টেস্ট ক্রিকেটে নিজের তৃতীয় শতক। মজার বিষয় হলো, ক্যারিয়ারের তিন অর্ধশতক কেই রূপ দিয়েছেন শতকে। অর্থ্যাৎ তার ক্যারিয়ারে তিন শতকের বিপরীতে অর্ধশতকের পাতা শূণ্য।

প্রথমদিনে প্রোটিয়াদের বোলিং তোপে দিনের শেষ কয়েক ওভারেই ৩৩ রানে চার উইকেট হারিয়ে বসে স্বাগতিকরা৷ অভিজ্ঞ আজহার আলীকে নিয়ে মাঠে থিঁতু না হয়েই দিন শেষ করেন ফাওয়াদ। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনে দু’জনের ৯৪ রানের জুটি ভাঙে লুঙ্গি এনগিডির শিকারে আজহার আলীর বিদায়ে। তখনও দলীয় সংগ্রহের অবস্থা সুবিধের নয়।

 

আজহার আলীর বিদায়েও ফাটল ধরানো যায়নি ফাওয়াদের আত্মবিশ্বাসে। ব্যাট চালিয়েছেন সাবলিলভাবেই। রাবাদা ও এনগিডির গতিতে কয়েকবার পরাস্ত হয়েও হারিয়ে যাননি। শারীরিকভাবে জখমের শিকার হয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেয়াল হয়ে। মনযোগে ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। মাঠের চারপাশে অনায়াসে চার-ছয়ের পসরা সাজিয়ে আদর্শ টেস্ট ইনিংসের পথেই এগিয়েছেন। দু’শোর অধিক বল মোকাবেলা করেও তাকে ক্লান্তি ছুঁতে পারেনি। দারুণ ক্ষিপ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিপক্ষের স্লেজিং কেও আমলে না নিয়ে লড়েছেন প্রাণপণে।

সফরকারীদের সীমিত সংগ্রহে গুটিয়ে দিয়েও, মুখের হাসি চওড়া করতে পারেননি পাকিস্তানের দুই কোচ মিসবাহ ও ইউনিস খান। পাশাপাশি নির্ভরতার প্রতীক বাবর আজমের বিমর্ষ চেহারাও খুঁজে নিয়েছে ক্যামেরার লেন্স। করোনা পরবর্তী প্রথম হোম সিরিজে নিজেদের এই করুণ পরিণতি মানতে পারছিলেন না খোদ অধিনায়ক। প্রতিপক্ষ কে দ্রুত অল-আউট করেও ব্যাট হাতে শক্তাবস্থানে দাঁড়াতে না পেরে উল্টো প্রোটিয়াদের লিড দেওয়ার পথেই ছিলো পাকিস্তান। ড্রেসিংরুমের দুশ্চিন্তার পাহাড়ে ফাওয়াদের শতক পৌঁছে দিয়েছে প্রশান্তির বার্তা।

দ্বিতীয় দিনের শুরুতে দ্রুত উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় সেশনেই পাকিস্তান কে গুটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে ফাওয়াদের ব্যাটিংয়ে। এক পাশ আগলে রেখে দল কে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্পিন-পেস সম্বলিত বোলিং লাইন-আপ কে তুলোধুনো করে ঘরোয়া লিগে নিজের ফর্মকে জাতীয় দলে টেনে এনে বাঁচিয়েছেন দলের সম্মান।

বাকিদের ব্যর্থতায় দলীয় সংগ্রহ উঁচুতে নিতে পারলেও, প্রতিপক্ষ কে লিড নিতে দেননি। নিজে লড়েছেন পাশাপাশি লড়ার সাহস জুগিয়েছেন ফাহিম ও রিজোয়ানের বুকেও। ফাহিমের অর্ধশতক ও রিজোয়ানের ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস দলের ভিত খানিকটা মজবুত করেছে।

বছর দশেক পর গতবছর পাকিস্তানের টেস্ট স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ফাওয়াদ আলম। ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপুটে পারফরম্যান্স নির্বাচকদের বাধ্য করেছে ৩৪ বছর বয়সেও তাকে পুনরায় দেশের ক্রিকেটের সেবা করার সুযোগ দিতে। বয়স কোনো বাঁধাই নয়, যেকোনো বয়সেই ফিট থাকা সম্ভব। ফাওয়াদ আলম তাই প্রমাণ করেছে আজকের পারফরম্যান্স। ঘরোয়া লিগে তো নিয়মিত প্রমাণ করে যান পারফরম্যান্স দিয়ে।

টেস্ট ক্রিকেটে শারীরিক ও মানসিক উভয়দিকেই পরীক্ষা দিতে হয় ব্যাপক। ফাওয়াদ আলম দু’দিকেই সফল। দৃঢ় মনোবলে লড়েছেন প্রতিটি বল। শতকের পথে প্রতিটি চার-ছয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন মাঠের চারপাশে। পাকিস্তানের ডুবতে থাকা তরীর নাবিক হয়ে পথের দিশা খুঁজে বের করেছেন। তীরে পৌঁছে দেওয়ার আগে নিজেও ডুবেছেন ১০৯ রানে, লুঙ্গি এনগিডির বলে।

তবে, তাঁর এই অসাধারণ ইনিংসে পাকিস্তান প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিনে অল-আউট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে বেঁচে গিয়েছে। প্রতিপক্ষ কে লিড উপহার দেওয়ার বদলে লিড নিতে পেরেছে পাকিস্তান। দ্বিতীয় দিনের সফলতার পাল্লা দু’দল সমানভাগে ভাগ করে নিলেও, ব্যক্তিগত অর্জনে ফাওয়াদ আলম ছিলেন দিনের আলোতেও তারার মত জ্বলজ্বল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link