ধূমকেতুর মতো বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর আগমন। অভিষেকেই দলের বিপর্যয়ে হাফ সেঞ্চুরি করে জানান দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে রাজত্ব করতেই এসেছেন তিনি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেই আগমনী বার্তার বেলুন উড়িয়েছেন আকাশচুম্বী। নামের আগে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মিস্টার ফিনিশার তকমা।এরপর সেই সময়ের স্রোতেই হারিয়ে গিয়েছেন তিনি! মাঝখানে পিছু নিয়েছিলো বিব্রতকর বিতর্কও।
বলছিলাম নাসির হোসেনের কথা। সুখময় স্মৃতি পিছনে ফেলে ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকা নাসির হোসেন এখন চেষ্টা করছেন ক্রিকেটে ফেরার। নিজকে আরো একবার প্রমাণ করার তাগিদে করে যাচ্ছেন পরিশ্রম। ফেরার লড়াইয়ে নাসির সুযোগ পেয়েছেছিলেন টি-টেন লিগে, রান করেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে – তবে সেটা জাতীয় দলে ফেরার জন্য যথেষ্ট ছিল না। মাঠের চেয়ে বরং মাঠের বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনই বেশি আলোচিত হয় আজকাল।
একটু পিছনে ফিরে নাসিরের ক্যারিয়ারটা যদি তিন ভাগে ভাগ করি। তবে তার প্রথম ভাগে যদি থাকে সফলতার গল্প, দ্বিতীয় ভাগে মিশে থাকবে শুধু হাহাকার, আর শেষ ভাগের পুরোটা জুড়েই থাকবে আক্ষেপ আর হতাশা।
ক্যারিয়ারে ৬৫ ওয়ানডেতে ২৯.১১ গড়ে করেছেন ১২৮১ রান। ছয়টি হাফ সেঞ্চুরির সাথে রয়েছে একটি সেঞ্চুরি। ১৯ টেস্টে ৩৪.৮০ গড়ে ছয় হাফ সেঞ্চুরি ও এক টি সেঞ্চুরির সাহায্যে করেছেন ১০৪৪ রান। টি-টুয়েন্টিতে ৩১ ম্যাচে ১৮.৫০ গড়ে করেছেন ৩৭০ রান। যেখানে হাফ সেঞ্চুরি ছিল দু’টি।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নাসির হোসেন ব্যাট হাতে ছিলেন অনবদ্য। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নিয়মিতই জাতীয় দলে খেলেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম ভাগের ৪৭ ওয়ানডেতে ৩১.৫১ গড়ে করেছেন ১১৭২ রান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৬ টি হাফসেঞ্চুরি ও একমাত্র সেঞ্চুরিটি নাসির করেছেন এই সময়েই। টেস্টে ১৭ ম্যাচে ৩৪.৯১ গড়ে করেছিলেন ৯৭২ রান।
টেস্ট ক্যারিয়ারের ছয়টি হাফ সেঞ্চুরি ও একমাত্র সেঞ্চুরিটি এসেছিলো এই স্বর্ণালী সময়েই। টি-টুয়েন্টিতে ২৯ ম্যাচে করেছেন ৩৬৭ রান, যার গড় ছিল ১৮.৮০। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ২ টি হাফসেঞ্চুরিও করেছিলেন তখন। এই সময়ে টেস্টে আটটি, ওয়ানডেতে ২৪ টি ও টি-টুয়েন্টিতে নিয়েছিলেন সাতটি উইকেট।
২০১৫ সালেই ক্যারিয়ারের সোনালি দিন গুলোর শেষই যেনো দেখে ফেলেছেন নাসির হোসেন। ২০১৫ সালে দেশের হয়ে সর্বশেষ টি-টুয়েন্টি ও ২০১৭ সালে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন নাসির হোসেন। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হয়ে আছে নাসির হোসেনের।
২০১৫ থেকে ২০১৮ এই সময়ে নাসির দলেও ছিলেন না নিয়মিত। এই সময়ে দলে আসা যাওয়ার উপরই ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে পারফর্ম করলেও দলে থিতু হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো না সেটি। এই সময়ে খেলা পাঁচটি ওয়ানডে খেলে করেছিলেন আট রান। নিয়েছিলেন এক উইকেট। দুই টেস্টে করেছিলেন ৭৩ রান, ছিলেন উইকেট শূন্য। টি-টুয়েন্টিতে দুই ম্যাচে করেছিলেন তিন রান, পেয়েছিলেন এক উইকেট।
দলে আসা যাওয়ার মাঝেই যখন থিঁতু হওয়ার চেস্টায় ছিলেন, তখনই ফুটবল খেলতে গিয়ে ইনজুড়িতে পড়েন নাসির হোসেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে অস্ত্রোপচার করে এসে মাঠে যখন ফিরলেন তখন ইনজুড়ি তার ক্যারিয়ার থেকে গ্রাস করে ফেলেছিলো মূল্যবান ছয় মাস। নাসিরের ক্যারিয়ারের দূর্দশার জন্য শুধু চোটই দায়ী নয়। নিজের অসচেতনতায় নাসির জড়িয়েছিলেন বিব্রতকর বিতর্কেও।
২০১৮ এর পর থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটেও অনিয়মিত হয়ে যান নাসির হোসেন। ২০১৮ এর বিপিএলে সিলেট প্রথম দিকে নাসিরকে মাঝে মাঝে সুযোগ দিলেও শেষের দিকে দলের সাথেই রাখেনি তাকে। এরপর টুকটাক ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও দলে আসার মতো পারফর্ম কখনোই ছিলো না নাসিরের।
গত বছরের মার্চ থেকেই করোনা বিপর্যয়ে মাঠের বাইরে ছিলো সব ধরনের ক্রিকেট। করোনা প্রোকোপের ভিতরই গত আগস্টে প্রেসিডেন্টস কাপ দিয়ে ক্রিকেটাররা মাঠে ফিরলেও ফেরা হয়নি নাসিরের। প্রেসিডেন্টস কাপে বিসিবি সুযোগ দিয়েছিলো জাতীয় দল, এইচপি দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটারদের।
তবে ফেরার সুযোগ পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি নাসির হোসেনকে। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে খেলার সুযোগ এসেছিলো নাসিরের সামনে। কিন্তু ফিটনেস টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পেরে সেই সুযোগও হারিয়েছিলেন নাসির। যদিও নাসির তখন বলেছিলো, তিনি তখন ইনজুরিতে ছিলেন, তিনি খেলার জন্য বিপ টেস্ট দেননি। চোটের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়াতে মাঝপথেই থেমে গিয়েছিলেন তিনি।
তবে সব বিতর্ক ফেলে আবারো আলোচনায় এসেছেন নাসির হোসেন। আবারো সুযোগ পেয়েছেন ক্রিকেটে ফেরার। আবুধাবিতে চলতি মাসের শেষের দিকে শুরু হতে যাওয়া টি-টেন লিগে অপ্রত্যাশিত ভাবে দল পেয়ে যান তিনি। প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে নাসির হোসেনকে কিনে নেয় পুনে ডেভিলস। নাসিরের সাথে টি-টেন লিগে দল পেয়েছেন আরো পাঁচ বাংলাদেশি ক্রিকেটার।
টি-টেন লিগে নাসির কেমন করবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে নাসির ক্রিকেটে ফিরছে এটাই সবচেয়ে বড় খবর। দেশে ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু হলে সেখানেও হয়তো খেলার সুযোগ হবে তার। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও জাতীয় দলে ফেরাটা সহজ হবে না নাসিরের জন্য।
জাতীয় দলে বেশির ভাগ সময়ই নাসিরকে খেলতে হয়েছে ৬/৭ নং পজিশনে। এখন সেখানে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মাদ সাইফউদ্দিন, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মেহেদী হাসান মিরাজ, শেখ মাহেদী হাসনরা। তবে জাতীয় দলের চিন্তা মাথায় না এনে নাসির হয়তো এখন চেষ্টা করবেন ক্রিকেটে অন্তত নিয়মিত হওয়া। সেই চেষ্টাও কি তাঁর আছে? কে জানে!