একটা ম্যাচের অপেক্ষায়

গ্যারি সোবার্স, ডেসমন্ড হেইন্স, গর্ডন গ্রিনিজ, ম্যালকম মার্শাল – এই নামগুলো শুনেছেন?

হ্যাঁ, তাঁরা সবাই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি। পাশাপাশি তাঁদের আরেকটা পরিচয় – এরা সবাই একসাথে বার্বাডোজের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন। সেই বার্বাডোজ নামে একটা দ্বীপ থেকে উঠে এসে সোবার্সরা বিশ্ব জয় করেছেন। তাঁদের পাশে ছিলেন তিনি। কিন্তু, সোবার্সদের পাশে পাশে থেকেই তিনি পারেননি বিশ্বজয় করতে।

অনেকবার সম্ভাবনা তৈরি করেও একবারের জন্য ডাক পাননি তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। অনেকবার তিনি নিজের প্রশংসা শুনেছেন, কাঁধের ওপর হাত দেখেছেন। কিন্তু একবারের জন্য ক্যারিবিয়ান জার্সিটা গায়ে জড়াতে পারেননি।

তাহলে? তাহলে কী তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন?

না, এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এখানেই তিনি সোবার্স, গ্রিনিজের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। জীবনের ৪৭টি বছর ধরে একটা, অন্তত একটা আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলার জন্য লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। অবশেষে সোবার্সরা যখন বৃদ্ধ হয়ে অবসর কাটাচ্ছেন, সেই সময়ে এসে স্বপ্নপূরণ করেছেন তিনি।

তিনি হয়ে উঠেছেন হাল না ছাড়া নাবিকের এক প্রতীক। তিনি একজন নোলান ক্লার্ক; স্বপ্নবাজ এক ক্রিকেট যোদ্ধা।

১৯৯৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৪৭ বছর ২৪০ দিন বয়সে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট অভিষেক হয়েছিলো নোলানের। একটা উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিলেন এই ক্যারিবিয়ান যোদ্ধা।

১৯৪৮ সালের ২২ জুন ক্যারিবিয়ান এলাকার সবচেয়ে বড় দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোজে জন্ম নোলানের। এই দ্বীপের আর সব শিশুর মতোই অ্যাথলেট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়ে উঠছিলেন। দৌড়বিদ, ফুটবলার বা ক্রিকেটার; যে কোনো কিছু হতে পারতেন নোলান। তবে বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটকেই।

সেন্ট মাইকেল স্কুলে পড়াশোনা করতেন। এখান থেকে আরও কয়েক জন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। বার্বাডোজ দলে গ্যারি সোবার্সদের সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন। ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে দারুন সম্ভাবনাময় ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পেয়ে যাবেন বলে মনে হচ্ছিলো।

বারবাডোজের বিখ্যাত স্পার্টান ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতেন। এখানে কিংবদন্তি সব বার্বাডিয়ান ক্রিকেটার খেলেছেন একসময়।

পেশোয়ারে বিশ্বকাপের ম্যাচ। সবার বাঁয়ে নোলান ক্লার্ক।

প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে দারুণ সময় কাটাচ্ছিলেন তখন। বিশেষ করে মাইক ডেনিসের নেতৃত্বাধীন সফরকারী এমসিসির বিপক্ষে ১৫৯ রানের ইনিংস খেলার পর তাঁকে নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শেষ বাঁধাটা টপকাতে পারেননি নোলান।

১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ফেলেন বারবাডোজের হয়ে। এরপর পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডসে। শুরুতে এই দেশটিতে ক্রিকেট খেলার কোনো লক্ষ্য ছিল না। ইউরোপে থিতু হওয়াই নোলানের মন ছিলো। কিন্তু রটেরডামে নোলান আবিষ্কার করেন, এখানেও ক্রিকেট জমে উঠেছে। এখানে কাজ শুরু করেন কোচ হিসেবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবিষ্কার করেন, ডাচদের চলমান খেলোয়াড়দের সাথে খেলার মত সামর্থও আছে তার।

ডাচ ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। শুরুতে কুইক হ্যাগ দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন। কুইকের হয়ে ২৬৫ রানের যে ইনিংস খেলেছিলেন, সেটা আজও ডাচ ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ইনিংস হয়ে আছে।

ততোদিনে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন নোলান। নব্বইয়ের শুরুর দিকেই নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলতে শুরু করেন। ১৯৯০ আইসিসি ট্রফিতে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন নোলান। কিন্তু সেবার নেদারল্যান্ডস ফাইনালে হেরে যাওয়ায় বিশ্বকাপ বা আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি। ১৯৯৫ সালে নেদারল্যান্ডসের হয়ে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে ৮৬ রানের ইনিংস খেলেন।

তবে আসল চমকটা অপেক্ষায় ছিলো।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করে ফেলে নেদারল্যান্ডস। আর এই দলের অন্যতম আকর্ষন ছিলেন নোলান ক্লার্ক। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভদোদোরায় অভিষেক হলো নোলানের। সাথে সাথে তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বয়সে অভিষিক্ত খেলোয়াড় হয়ে গেলেন। এর আগে এই রেকর্ড করেছিলেন ৪৪ বছর বয়সী ইংল্যান্ডের নোরম্যান গিফোর্ড।

প্রথম ম্যাচে ১৪ রান করেছিলেন। পরের ৩ ম্যাচে যথাক্রমে-০, ৪ ও ০। শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করলেন ৩২ রান। আর ওটাই নোলানের শেষ আর্ন্তজাতিক ম্যাচ হয়ে রইলো। বিশ্বকাপের পরই অবসর নিয়ে নিলেন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট থেকে।

২০০৫ সালে আবার ফিরে এসেছিলেন ক্রিকেটে। ৬ বছর বিরতি দিয়ে ৫৬ বছর বয়সে আমস্টার্ডামের হয়ে খেলেছিলেন সে বছর। এরপর খেলাকে চিরতরে বিদায় জানান। কিন্তু ক্রিকেটকে এখনও বিদায় বলেননি।

এখনকার নোলান কার্ক।

এই ৭২ বছর বয়সে এখনও ক্রিকেট কোচিং করিয়ে যাচ্ছেন নোলান। কে জানে, তার হাত ধরে হয়তো নেদারল্যান্ডসের কোনো এক তারকা উঠে আসবেন।

কারণ, নোলান তো হাল ছাড়েন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link