অদম্য যোদ্ধা, মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানদের একজন তিনি। আশির দশকে হ্যাট পরে বাংলাদেশের একটা ছেলে ব্যাটিং করছে। এ যেনো স্বপ্নের মত একটা ব্যাপার। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন ক্রিকেট ধারাভাষ্যের সাথে এবং প্রায় দুই দশক ধরে একাই কমেন্ট্রি বক্সে লড়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের হয়ে। সাকিব-তামিমদের সাফল্যে আতাহার আলী খানের আওয়াজ ভেসে ওঠে ক্রিকেট বিশ্বের আনাচে-কানাচে।

১৯৬২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্ম নেয়া আতহার আলী ছোটবেলা থেকেই ভালবাসতেন ক্রিকেটকে। প্রায় একা হাতেই নিজের স্কুল, কলেজকে এনে দিয়েছেন অসংখ্য জয়। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও আপোষ করেননি ক্রিকেটের সাথে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলে গেছেন এবং ১৯৮৫ সালে অভিষিক্ত হন বাংলাদেশ জাতীয় দলে।

আতাহার আলী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যখন খেলেছেন তখন বাংলাদেশ মাত্র ক্রিকেট দুনিয়ায় হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। সেই সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলারদের বিপক্ষে কলার উঁচু করে ব্যাট করতে নামতেন। মাথায় একটা হ্যাট পরে ব্যাট করতে নামা আতাহার ছিলেন ঠিক আজকের মতই স্টাইলিশ। সেই সময় তাঁর ফুটওয়ার্ক, ড্রাইভ কিংবা ফ্লিক দেখে মনে হতো সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে তিনি। তাঁর সময় বাংলাদেশ দলটার অবস্থা যে ভালো ছিল না।

তবুও নিজের মত করে খেলে গিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ কেনিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ওয়ানডে জয় তুলে নেয়। সেই ম্যাচেও মোহম্মদ রফিকের সাথে ১৩৭ রানের ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন। আতাহারের ব্যাট থেকে এসেছিল ৪৭ রান।

তবে সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ইনিংসটি খেলেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৯৭ সালে এশিয়া কাপের সেই ম্যাচে আকিব জাভেদ, সাকলাইন মুশতাক কিংবা তরুণ শহীদ আফ্রিদিদের বিপক্ষে ব্যাটিং করেছেন। ব্যাট করতে নেমেই দারুণ একটা ড্রাইভ খেলে শুরু করেছিলেন। এরপর উইকেটের চারপাশে প্রায় সবরকম শটই খেলেছেন।

আউট হবার আগে করেছিলেন নিজের ক্যারিয়ার সেরা ৮২ রান। যদিও সেই আউট নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। অনেকের মতে সেদিন বেনিফিট অব দ্য ডাউট আতাহার আলীকে দেয়া হয়নি। নাহলে হয়তো সেদিনই ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে পাওয়া যেত আতাহার আলীকে।

সেই সময় খেলেছিলেন বলেই খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। তবে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে ডান হাতি এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ১৯ ম্যাচে গড়ে প্রায় ৩০ করেছিলেন ৫৩২ রান। বোলার হিসেবেও ছিলেন বেশ কার্যকরী। মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং করে তুলে নিয়েছিলেন ছয় উইকেট।

যদিও ক্রিকেটকে ঠিক বিদায় জানানো হয়ে উঠেনি তাঁর। আজও বাংলাদেশ দলের সাথে দেশ বিদেশে ছুটে চলেছেন অক্লান্ত পথিক হয়ে। এখনকার সময়ে এসে ৬ ফুট ২ ইঞ্চির সুদর্শন আতহার আলী অবশ্য কমেন্টেটর হিসেবেই অনেক বেশি পরিচিত। অনেকে আদর করে যাকে বলেন ‘দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ’।

২০০০ সালে বাংলাদেশ -ভারত ম্যাচের মধ্যদিয়ে কমেন্ট্রি বক্সে অভিষিক্ত হন তিনি। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানো নয় বরং টাইগারদের সাথে ছুটে গেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। কমেন্ট্রি বক্সে বিশ্বের সব বিখ্যাত কমেন্টেটর দের সাথে ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

‘বাংলাওয়াশ’ শব্দটাও প্রথম ব্যবহার করেন আতহার আলী খান। সাকিবরা যখন প্রথম ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড কে হোয়াইট ওয়াশ করলো তখনই কমেন্ট্রি বক্সে আতহার আলী খানের মুখে উচ্চারিত হলো “বাংলাওয়াশ”। এরপর অনেক দলকেই বাংলাওয়াশ করেছে টাইগাররা। আর প্রতিবারই কমেন্ট্রি বক্সে বাংলাওয়াশ শব্দটি উচ্চারিত হয় বিভিন্ন কমেন্টেটরের মুখে।

যদিও তাঁর কমেন্ট্রি নিয়ে আজকাল নানারকম সমালোচনাই হয়। ফেসবুকে বাজে ভাবে ট্রলের স্বীকারও হন কখনো কখনো। আতাহার আলীও এসব জানেন। তবুও ক্রিকেটটাকে ভালোবেসে নিজের কাজটা করে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর আমরাই বা আরেকটা আতাহার আলী তৈরি করতে না পারার ব্যার্থতার দায় তাঁর উপর চাপিয়ে দিই কী করে।

আশির দশকে কী দারুণ স্টাইলিশ এক ব্যাটসম্যান হিসেবে বাংলার ক্রিকেটে পদার্পন করেছিলেন। ২০০০ সাল থেকে নিজের সেই লেগেসি বয়ে চলেছেন কমেন্ট্রি বক্সেও। নানা আলোচনা-সমালোচনার পরেও বাংলার ক্রিকেটে কিংবা কমেন্ট্রি বক্সে আরেকজন আতাহার কই। আজও টাইগাররা যখন দেশের হয়ে বাইশ গজে লড়েন তখন ধারাভাষ্য কক্ষে বাংলাদেশের হয়ে লড়ে যান আতহার আলী খান। দলের সাথে আতহার আলী খানের এই পথচলা চলুক অবিরাম।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link