৯৬’র সেই বিদ্রোহী বুড়ো

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সাথে তাঁর সম্পর্ক নেই। তবে, শ্রীলঙ্কার সাথে আছে। বড়দিন এলে আজও প্রায়ই দেশে ফেরেন। ভাইবোনরা সবাই লঙ্কাতেই থাকেন। তাঁদের সাথে সময় কাটান। হয়তো তখন একটা আক্ষেপও উঁকি দেয় মনে। একটু ঊনিশ-বিশ হলে এই দেশটার জাতীয় দলের জার্সিটাও তাঁর হতে পারতো!

ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফো – এই সংবাদ সংস্থাকে কে না চেনে। আর ক্রিকইনফোর যারা খুব নিয়মিত পাঠক তাঁরা ‘আস্ক স্টিভেন্স’ বিষয়টার সাথেও কমবেশি পরিচিত।

সেখানে, স্টিভেন লিঞ্চ নামের এক পরিসংখ্যানবিদ অজস্র বিচিত্র সব ক্রিকেট পরিসংখ্যানের খোড়াক মেটান পাঠকদের। যে কেউ চাইলে তাঁকে যেকোনো পরিসংখ্যান বিষয়ক প্রশ্ন করতে পারেন।

তো, সম্প্রতি সেখানে ইংল্যান্ড থেকে এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছেন, ‘আচ্ছা, আমি ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপটা খেলেছিলাম হল্যান্ড দলের হয়ে। পাকিস্তানের বিপক্ষে একটা হাফ সেঞ্চুরি করেছিলাম। তখন আমার বয়স ৪৩ বছর, আমাকে বলা হয়েছিল – এত বয়সে এর আগে কেউ নাকি সেঞ্চুরি করেনি। আমি জানতে চাই, রেকর্ডটা কি এখনও টিকে আছে?’

এমন প্রশ্নটা দেখে যে কারোরই চমকে ওঠাটা স্বাভাবিক। স্টিভেন্স চমকে উঠেছিলেন কি না জানা যায়নি। তবে, তিনি খুব বিনীতভাবে উত্তর দিয়েছেন, ‘জানাশোনা কোনো মানুষের কাছ থেকে প্রশ্ন পাওয়াটা সব সময়ই তৃপ্তিদায়ক। আমি খুবই আনন্দের সাথে নিশ্চিত করতে চাই যে, আপনার রেকর্ডটা এখনও টিকে আছে। আপনিই বিশ্বকাপের মঞ্চে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যাটসম্যান হিসেবে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন।’

সেই ভদ্রলোকের নাম হল ফ্লাভিয়ান আপোনসো। জন্ম ১৯৫২ সালে। লাহোরে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি করেছিলেন ৫৮ রান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর ১২১ দিন।

তিনি বহাল তবিয়তে এই রেকর্ডটা নিজের করে রেখেছেন। অন্য কারও পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন মিসবাহ উল হক। ২০১৫ বিশ্বকাপে যখন মিসবাহ হাফ সেঞ্চুরি করেন, তখন নিজের ৪২ তম জন্মদিন থেকে দুই মাস দূরে আছেন তিনি।

আপোনসো মূলত শ্রীলঙ্কান। সেখানে তাঁর পরিচয় অবশ্য একজন ‘বিদ্রোহী’র। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বিদ্রোহী সফরে গিয়েছিলেন। তখনই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট (এসএলসি) তাঁকে নিষিদ্ধ করে। তখনই তিনি পাড়ি জমান ইউরোপে। বিশ্বকাপের আগে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেন ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফি। এরপর আর কখনও ফেরা হয়নি সিংহের দেশে। যদিও, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলেন সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও।

ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন মূলত টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। অফস্পিন বোলিংটাও ছিল বেশ কার্যকর। লঙ্কান জাতীয় দলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন, কিন্তু বিদ্রোহ করায় তাঁকে কখনো সুযোগই দেয়নি শ্রীলঙ্কা। বিশেষ করে, ওই সফরে যাওয়ার আগেই তাঁকে জাতীয় দলে নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ চলছিল। কে জানে, সুযোগ পেলে হয়তো তিনি শ্রীলঙ্কার হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেন, আরও খ্যাতি পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।

শ্রীলঙ্কার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেললেও টেস্ট জমানার আগে একবার শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে গোপালান ট্রফিতে তিনি অংশ নেন সেলন দলের হয়ে, তামিল নাড়ুর বিপক্ষে একটা ম্যাচও খেলেন। সেলন দলটা মূলত শ্রীলঙ্কার জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়েই বানানো হত।

এখন তিনি অবশ্য শ্রীলঙ্কা বা নেদারল্যান্ডস কোথাও থাকেন না। তাঁর ঠিকানা ইংল্যান্ডে। যদিও, নেদারল্যান্ডস ক্রিকেটে নানা ভূমিকায় তিনি দুই যুগেরও বেশি সময় ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসে পেশাদার ক্রিকেটার ও কোচ হিসেবে ২৫ বছর কাটানোর পর ২০০৫ সালে আমি ইংল্যান্ড চলে আসি। তিনটি ক্লাবের জুনিয়র দলের হয়ে আমি কোচিংয়ে যুক্ত হই। বিভিন্ন প্রাইভেট কোচিংয়েও যুক্ত হই। আমার বয়স ৬৮, এই বুড়ো বয়সেও ক্রিকেটে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত।’

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সাথে তাঁর সম্পর্ক নেই। তবে, শ্রীলঙ্কার সাথে আছে। বড়দিন এলে আজও প্রায়ই দেশে ফেরেন। ভাইবোনরা সবাই লঙ্কাতেই থাকেন। তাঁদের সাথে সময় কাটান। হয়তো তখন একটা আক্ষেপও উঁকি দেয় মনে। একটু ঊনিশ-বিশ হলে এই দেশটার জাতীয় দলের জার্সিটাও তাঁর হতে পারতো!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...