রূপকথার সাথে পরিচয় আছে যাদের, তাদের সবার রাজপুত্র শব্দটা চেনা। শব্দটি ভাবলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে জমকালো পোশাক পরা তলোয়ার হাতের খুব সুদর্শন কোনো একটি অবয়ব। রূপকথায় রাজপুত্রের শৌর্য-বীর্য হয় অনন্য, তার উপস্থিতি উদ্ভাসিত করে চারপাশ। ফুটবলের সবুজের গালিচাতেও তেমন একজন রাজপুত্র আছেন; তিনি রিকার্ডো ইজেকসোঁ দো সান্তোস লেইচি, রিকার্ডো কাকা নামে যাকে চেনে ফুটবল বিশ্ব।
১৯৮২ সালের ২২ এপ্রিল ব্রাজিলের সাও পাওলোর এক পরিবারে জন্ম রিকার্ডো কাকা’র ৷ ব্রাজিলের অন্য আট-দশটা শিশুর মতই ফুটবল হয়ে ওঠে কাকার দ্বিতীয় ধর্ম। মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি সুযোগ পান সাও পাওলো ক্লাবে। পনেরো বছর বয়সে সে ক্লাবেই প্রথম পেশাদার চুক্তিতে সাক্ষর করেন কাকা।
সে বছর সাও পাওলো ক্লাবের যুবদলের হয়ে কোপা ডি জুভেনিল জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন কাকা। যুব দলের হয়ে তার এমন পারফরম্যান্সের পুরস্কার স্বরূপ ২০০১ সালে কাকা’কে যুবদল থেকে মূল দলে সুযোগ দেওয়া হয়।
২০০২ সালে কাকা সাও পাওলো ক্লাবকে প্রায় একক কৃতিত্বে ব্রাজিলের একটি ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট Torneio Rio এর শিরোপা জেতান। সে বছরই ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর নজরে পড়েন এই ব্রাজিলিয়ান।
২০০৩ সালে ইউরোপের স্বনামধন্য ক্লাব এসি মিলান প্রথমবারের মত রিকার্ডো কাকা’কে ইউরোপীয় ফুটবলের স্রোতে নিয়ে আসে। প্রথম মৌসুমেই পারফরম্যান্স দিয়ে মিলানের প্রথম একাদশে নিজের জায়গা করে নেন তিনি। সেই মৌসুমে মিলানের হয়ে সিরি এ আর উয়েফা সুপার কাপ জেতেন কাকা, পাশাপাশি রানার আপ হয়েছিলেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ এবং ইতালিয়ান সুপার কোপাতে। পুরো মৌসুম জুড়ে দাপট দেখানো কাকা সে মৌসুমের সিরি ‘এ’ এর বর্ষসেরা বিদেশি ফুটবলারের পুরস্কারটি নিজের করে নেন।
২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মিলানের হয়ে একটি বড় ধাক্কা হজম করেন কাকা। ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকেও সেদিন হারতে হয়েছিল লিভারপুলের কাছে। ফাইনাল ম্যাচে-ও ফ্রি কিক থেকে একটি গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। সে মৌসুমের চ্যাম্পিনয়ন্স লিগে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের মালিক ছিলেন কাকা।
দু:খের পরেই তো আনন্দের আগমন। প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি কাকার ক্যারিয়ারেও। ২০০৫ সালের দুঃখ গাঁথার পর এসেছিল ২০০৬-০৭ মৌসুম। সে মৌসুমে কাকা হয়ে উঠেছিলেন আরও অপ্রতিরোধ্য, আরও তীক্ষ্ণ।
সে বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লীগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন কাকা। ফাইনালে লিভারপুল’কে হারিয়ে সেই পুরোনো পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার পাশাপাশি গর্বের চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে নেয় এসি মিলান।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১০ গোল) হন রিকার্ডো কাকা। এছাড়া তিনটি অ্যাসিস্টও এসেছিল তার পা থেকে। তবে শুধুমাত্র গোল সংখ্যা দিয়ে কাকার পারফর্মেন্স বিচার করে তার পুরো কৃতিত্বটা বোঝা যাবে না।
গ্রুপ পর্বে হ্যাটট্রিক, শেষ ষোলোর ম্যাচে সেল্টিক এফসির বিপক্ষে ৯৩ মিনিটের ম্যাচ জেতানো গোল, কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে এক গোল এবং এক অ্যাসিস্ট, সেমি ফাইনালে ওয়েইন রুনির ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে চোখে লেগে থাকার মত দুইটি গোল কিংবা ফাইনালে একটি অ্যাসিস্ট; এসব কাকা’র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ পথযাত্রার অংশ।
কাকার গোল, অ্যাসিস্ট কিংবা প্রতিপক্ষের ডিফেন্স গুঁড়িয়ে দেওয়া; দর্শকদের হৃদয়ে ধারন করতে হয় এমন শিল্পের প্রদশর্নী; সংখ্যায় কিংবা বর্নমালায় ফুটিয়ে তোলা যায় না।
পায়ের জাদুতে মিলানের নায়ক হয়ে ওঠা রিকার্ডোকে নি:শর্ত ভালোবেসে ছিল মিলানবাসী কিন্তু অর্থনৈতিক কারনে এসি মিলান বাধ্য হয় তাদের নায়ককে বিক্রি করে দিতে।
৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইতালি ছেড়ে স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রিকার্ডো কাকা। রিয়াল মাদ্রিদের কাকার ক্যারিয়ারটা খুব ভালোভাবে কাটেনি। হাঁটুর ইনজুরির কারনে প্রায়ই লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। ফলে ছন্দপতন ঘটেছিল মাঠের পারফরম্যান্সে-ও। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১২০ টি ম্যাচে মাত্র ২৯ টি গোল এবং ৩৯ টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। দলের হয়ে জিতেছেন একটি করে লা লিগা, কোপা দেল রে আর স্প্যানিশ সুপার কাপ।
এমন সংখ্যা অন্য যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য চমৎকার হলেও ব্রাজিলিয়ান এই সেনশেসনের নামের পাশে জন্য যথেষ্ট ছিল না। প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলতা না পাওয়ায় ২০১৩ সালে পুনরায় পুরোনো আশ্রয়ে ফেরেন এই আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডার। এসি মিলানের হয়ে সিরি ‘এ’-তে কাটান আরও এক বছর। ক্যারিয়ারে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা মিলিয়ে রোজোনেরিদের হয়ে মোট ৩০৭ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন কাকা। এসময় তিনি ১০৪ গোল এবং ৮৫টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন।
২০১৪ সালের মেজর সকার লিগে সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে চলে যান৷ অরল্যান্ড সিটির হয়ে ৭৮ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২৫ গোল এবং করিয়েছিলেন ১৯টি গোল। অরল্যান্ড সিটির হয়ে ২০১৭ সালে সর্বশেষ মাঠে নেমেছিলেন রিকার্ডো কাকা। এরপরই নিজের বুট জোড়া তুলে রাখেন তিনি।
ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে কাকার অভিষেক হয় ২০০২ সালে। সে বছরই তিনি বিশ্বকাপের তারকা খচিত ব্রাজিল দলে সুযোগ পান, তবে কোস্টারিকার বিপক্ষে এক ম্যাচের ২৫ মিনিট ছাড়া আর মাঠে নামা হয়নি তার। তবু সে বিশ্বকাপের ট্রফি জয়ী দলের গর্বিত একজন তিনি।
২০০৫ সালের কনফেডারেশন কাপে অবশ্য দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে প্রতিটি ম্যাচেই খেলেছিলেন কাকা এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল সেলেসাও-রা। ২০০৯ সালের কনফেডারেশন কাপেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতার পাশাপাশি শিরোপাও জিতেছিলেন রিকার্ডো কাকা।
এছাড়া ২০০৬ এবং ২০১০ বিশ্বকাপে কাকা ছিলেন ব্রাজিল দলের মধ্যমণি ৷ অবশ্য নিজে পারফর্ম করলেও দলীয় ব্যর্থতায় কিছু জেতা হয়নি তার। ২০১০ আফ্রিকা বিশ্বকাপে বিতর্কিত এক লাল কার্ডে রিকার্ডো কাকা’র মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আজও দুঃসহ যন্ত্রণা হয়ে আছে ভক্তদের স্মৃতিতে।
নিজের ছোট এই ক্যারিয়ারে সেলেসাওদের হয়ে ৯২ ম্যাচে ২৯টি গোল করেছেন কাকা। মজার ব্যাপার, কাকার গোল করা ম্যাচে কখনোই হারেনি টিম ব্রাজিল।
বল পায়ে ছুটন্ত রিকার্ডো কাকাকে কোন ডিফেন্ডার থামাতে না পারলেও ইনজুরি নামক অভিশাপ থামিয়ে দিয়েছিল কাকার সম্ভাবনাময়ী ক্যারিয়ারকে। পুরো ক্যারিয়ারেই বারবার ইনজুরির জন্যই পিছিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
প্রতিভার বিচারে কাকা ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারদের একজন হলেও, সেই প্রতিভার সবটুকু ফুটবলের মাঠে দেখানোর সুযোগ বিধাতা দেয়নি তাঁকে।
ছোট একটি ক্যারিয়ারের অর্জন দিয়ে ফুটবল ইতিহাসে তেমন কোন উঁচু স্থানে নেই রিকার্ডো কাকা, তবে তাঁর প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের ভালবাসার রাজপুত্র হয়ে আছেন। হয়তো দু:খী কিংবা দুর্ভাগা রাজপুত্র হিসেবেই, কারন তিনি যে রাজপুত্র থেকে কখনো যুবরাজ হয়ে উঠতে পারেননি।