নবদিগন্তের জ্যোতির্ময় ফুটবল বিজ্ঞানী

ইয়োহান ক্রুইফ হাফ টাইমের বিরতিতে ছেলেটাকে ডেকে বললেন, ‘এই যে শোনো, তুমি যা দৌড়চ্ছ ওর চেয়ে আমার আশি বছরের বৃদ্ধা ঠাকুমা বেশি গতিতে দৌড়ায়। যদি খেলাটা মন থেকে খেলতে চাও তাহলেই খেলো। নইলে এই দল তোমার জন্য নয়।’

ক্রুইফের অপমানটা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না একরোখা ছেলেটার পক্ষে। কাতালান জার্সিটা গায়ে ভারী লাগছিল খুব। যে বার্সেলোনাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে চাইল, সি দলে খেলতে এসে সেই ক্লাবেরই প্রাণপুরুষ অপমান করলেন তাঁকে।

এই রাগটা জেদে পরিণত করতে পারলেন তিনিই কারণ তাঁর নাম জোসেপ গার্দিওলা সালা- ১৯৯২ সালে এই জোহান ক্রুইফের স্বপ্নের বার্সেলোনা দলের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি। ক্রুইফীয় ফুটবল দর্শনের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার, ফুটবলের সফলতম বিজ্ঞানী।

২০০৮-২০০৯ মৌসুম। বার্সেলোনা ‘বি’ থেকে সিনিয়র টিমে কোচ হয়ে এলেন পেপ। প্রথমদিন এসেই প্রেস কনফারেন্সে বললেন, ‘বন্ধুরা আমরা একসাথে একটা যাত্রা শুরু করতে চলেছি, এই সফরে আমরা কখনো জিতবো, কখনো জিততে পারবো না কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমরা আগামী কিছুদিন অনেক অনেক ট্রফি জিততে চলেছি।’

জীবনের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে, তাঁর অবিরাম স্পন্দন আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। স্বপ্নের ভিতর বাঁচার কথা বলে। ফুটবলে ট্রফি একটা মাইলস্টোন, কিন্তু আসল হল পথ, মাইলস্টোন তাঁর পাশে রাখা সোপান- পেপ এই পথ দিয়ে হাঁটলেন, ফুটবলের স্পন্দনে ধন্য হল রাজপথ।

ক্রুইফ বলতেন, ‘অলওয়েজ মুভ ফরোয়ার্ড।’ পেপ যেন ক্রুয়েফের শেষবিন্দু থেকে শুরু করলেন লড়াইটা। সেই মৌসুমে জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসি-দানি-ইব্রাদের কোচ সকালে ট্রেনিং-এ এসেই বলতেন, ‘তোমরা খেলতে না পারলে আমি রাগ করব না, চেষ্টা না করলে এই দলে জায়গা হবে না, মাঠে কেউ পেছনে ফিরে তাকাবে না, আমাদের লক্ষ্য হবে সামনের দিকে এগিয়ে চলা।’

পেপ এগিয়ে চললেন। প্রথম মৌসুম। প্রথম কোন সিনিয়র দলকে কোচিং করিয়ে পেপ এনে দিলেন ট্রেবল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ২-০ গোলে পেপের সামনে থেমে গেলেন স্যার আলেক্স ফার্গুসনও। কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম মৌসুমে টানা দুবার সেরা কোচের খেতাব জেতা আলেক্স ফার্গুসনের থেকে ফিফার সেরা কোচের শিরোপা গেল পেপের মাথায়।

এরপর তরুণতম কোচ হিসেবে জিতলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। পরবর্তী অধ্যায়? হ্যাঁ! স্প্যানিশ ফুটবলের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে ধন্য হল ইউরোপ। চার মৌসুমে ১৪ টা ট্রফি। সাকির মিলান আর আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালের পর আধুনিক ফুটবলের মানচিত্র বদলে দিলেন রোগাসোগা চেহারার স্প্যানিশ মাস্টার।

পেপ বায়ার্ন মিউনিখে কোচিং করানোর সময় বলছিলেন, ‘আমি কোনোদিন শুধুমাত্র ট্রফির জন্যে কোচিং করাই না। ফুটবলের সঠিক পথ দিয়ে একটা ফুটবল দর্শনকে ঐ পথের একেবারে শেষ সীমানাটায় নিয়ে যেতে যা যা করণীয় আমি করব।’

এই জন্যেই হয়ত জার্মানি পৌছেই অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারিনা যাবার আগে পেপ পৌঁছে যান জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে। এই জন্যেই হয়ত ইংল্যান্ডে এসে ঘুরে দেখেন ম্যানচেস্টারের রাস্তাঘাট। কথা বলেন সাধারণ মানুষের সাথে। পেপ জানেন একটা ফুটবল ক্লাবের সাথে জড়িয়ে থাকে তার ইতিহাস, তার সংস্কৃতি- সেই সংস্কৃতির কথা ফুটবলের পায়ে পায়ে লিখে দিতেই তিনি ঘুরে বেড়ান স্পেন থেকে জার্মানি হয়ে ইংল্যান্ড।

রাইনাস মিশেলের কোচিংয়ে ইয়োহান ক্রুইফ বিশ্বকাপ জিততে পারেন নি, হাতছাড়া হয় ফাইনালে। ট্রফি যদি শেষ কথা হত তাহলে হয়ত ফুটবল ক্রুয়েফকে মনে রাখত না। মিশেল বলেছিলেন, ‘আমরা ট্রফি জিতি নি কিন্তু একটা ফুতবলের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছি।’ এই নতুন দিগন্তেই জ্যোতির্ময় হয়ে এলেন পেপ গার্দিওলা।

ইতিহাস পাল্টে যাবে। ট্রফির ক্যাবিনেটে পেপকেও ছাপিয়ে যাবেন হয়ত কেউ কিন্তু পেপ গার্দিওলা সেদিনের সেই একরোখা ছেলেটা যে শুধু খুঁজে বেড়াবে ফুটবলের নতুন নতুন পথ। ম্যাচ শেষে ঘরে ফিরেই বসে পড়বেন খেলোয়াড়দের খুঁটিনাটি নিয়ে স্ক্রিনের সামনে। হাতে দুটো জলের বোতলের ক্যাপ নিয়েই ফুটবলের ব্যাকরণ লিখতে বসবেন ফুটবল বিজ্ঞানী, সেই নতুন পথের লক্ষ্যে ছুটবেন পেপ যে পথ দিয়ে বয়ে যায় নানা দেশের নানা ভাষার চিরন্তন ফুটবল সংস্কৃতি!

অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ইয়োহান ক্রুইফ হাসবেন, সন্ধ্যা নেমে এলে গার্দিওলা। নিজের মিষ্টি হাসিটা ছুঁড়ে দেবেন আকাশের গায়ে, তাতে লেগে থাকবে ফুটবলের মেলোডি। ফুটবলের সাইড লাইনের ভেতর নয়, আমরা আকাশের গায়ে কান পাতলে শুনতে পাবো সেই চিরন্তন সুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link