আট অক্টোবর, ২০০৫ সাল। সামনেই অপেক্ষমাণ ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ। আফ্রিকায় তখন জমে উঠেছিল বাছাই পর্বের লড়াই। আইভরি কোস্ট এবং ক্যামেরন দুই দেশের সুযোগ ছিল বিশ্বকাপের টিকেট জেতার। নিজেদের শেষ ম্যাচে সুদানকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের কাজটা করে রেখেছিলো আইভরি কোস্ট।
তবে, ক্যামেরন জিতে গেলে ক্যামেরনই জার্মানির বিমান ধরার সুযোগ পেতো। এমন সমীকরন সামনে রেখে খেলতে নেমে ক্যামেরন নিজেদের শেষ ম্যাচে ৯৩ মিনিটে পায় পেনাল্টি; গোল করলেই স্বপ্নের বিশ্বকাপ। তবে ফুটবল বিধাতা হয়তো লিখে রেখেছিলেন অন্য ইতিহাস; ক্যামেরন মিস করেছিলো পেনাল্টি। আর আইভরি কোস্ট নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে জায়গা করে নিল।
এমন অর্জনের পর বুনো উল্লাস নয় বরং সভা সমাবেশ করে ২০০২ থেকে আইভেরি কোস্টে চলমান গৃহযুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন খেলোয়াড়রা। খেলার মাঠের অধিনায়কের মতই রাজনীতির ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একজন; তিনি দিদিয়ের দ্রগবা। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবাগ ভাষনের মতই দিদিয়ের তার দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে যুদ্ধ লিপ্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
উত্তরাঞ্চলের মুসলিম বিদ্রোহীদের সঙ্গে দক্ষিনের খ্রিষ্টান ও সরকারসমর্থিত গোষ্ঠীর তীব্র রেষারেষিতে যখন ক্ষতবিক্ষত ছিল আইভরি কোস্ট; তখনই তার জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘোষনা এসেছিলো। ‘নেতা’ দিদিয়েরের কথা ফেলতে পারেনি কেউ। অস্ত্র নয়, সেদিন একবুক ভালবাসা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল মানুষ। নেমেছিল উৎসবের বহর।
দিদিয়ের দ্রগবা ১৯৭৮ সালের ১১ মার্চ জন্মগ্রহন করেছিলেন আইভরি কোস্টের পুরোনো রাজধানী আবিজান শহরে। পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় লি ম্যান্স ক্লাবে। ইউরোপীয় ফুটবলে প্রথম আগমন ঘটে অলিম্পিক মার্শেই এর হয়ে। ২০০৩-০৪ এই এক মৌসুম ফ্রান্সে কাটানো দ্রগবা ৩৫ ম্যাচে করেছিলেন ১৮ গোল।
এক বছর পরেই ফ্রান্স থেকে যোগ দেন ইংলিশ ক্লাব চেলসি-তে। চেলসি-তে থাকাকালীন নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। শুধু গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নয়; তাঁর খেলার ধরনই ইউরোপ জুড়ে সৃষ্টি করেছিল কোটি ভক্ত। ২০১১-১২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে নাটকীয় এক সমতাসূচক গোল করে ম্যাচকে নিয়ে গিয়েছিলেন অতিরিক্ত সময়ে। ট্রাইব্রেকারে বায়ার্ন মিউনিখের শেষ পেনাল্টি বাস্তিয়ান শোয়ানইনস্টাইগার মিস করেছিলেন। এরপর চেলসির হয়ে শট নিতে আসেন দিদিয়ের।
বল জালে জড়াতে একটুও ভুল করেননি এই আফ্রিকান। চেলসিকে জেতালেন বহু আরাধ্য উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রুপালি ট্রফিটা। আর ট্রফি হাতে দ্রগবার ‘আইকনিক সেলিব্রেশন’ হয়তো আজও চোখে লেগে আছে দর্শকদের। এই ম্যাচের পরেই রাজার হালে চেলসিকে বিদায় বলেছিলেন দ্রগবা।
চেলসি ছেড়ে গেলেও ‘ব্রুজ’ সমর্থকরা মনে রেখেছিলো দ্রগবাকে, দ্রগবাও তাদের ভালবাসার টানে ফিরে এসেছিলেন। চীন তুরস্ক ঘুরে চেলসিতে দ্বিতীয়বারের মত যোগ দেন দিদিয়ের দ্রগবা। সেবারও বিদায় নিয়েছিলেন রাজসিক ভাবেই; বিদায় মৌসুমেই জিতেছিলেন প্রিমিয়ার লিগ। জাতীয় দলের হয়ে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ খেলেছিলেন; জিতেছিলেন বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলার এর পুরষ্কার। দ্রগবাকে তর্কসাপেক্ষে এখনও আফ্রিকার সর্বকালের সেরা ফুটবলার মানা হয়।
তবে পুরস্কার কিংবা মাঠের অর্জন নয়; দিদিয়ের দ্রগবাকে মানুষ মনে রাখবে গৃহযুদ্ধ নিরসনের জন্য; মনে রাখবে একজন কিংবদন্তি কিংবা তারচেয়ে বেশি কিছু হিসেবে। দ্রগবাও হয়তো তাই চেয়েছেন। তার সাক্ষাৎকারেই তাই বোঝা যায়। তার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমি অনেক ট্রফি জিতেছি। কিন্তু এদের কোনোটিই আমাকে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি মর্যাদা ও আনন্দ দেয়নি!’
তিনি হয়ে উঠেছিলেন আইভরি কোস্টের অবিসংবাদিতভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। চকলেট,জুতা কিংবা মোবাইল ফোন; আইভরি কোস্টের বাজারজাতকৃত প্রায় প্রতিটি পণ্যের প্রসারেই ব্যবহৃত হয়েছিলো এই ফুটবলার।
একজন ফুটবলার, দিদিয়ের দ্রগবা, যার এককথায় থেমে গিয়েছিল পাঁচবছর ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এমন একজন ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবা যিনি জীবনের মায়া ছেড়ে বিদ্রোহীদের শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন, হাতে হাতে মিলিয়ে দিয়েছিলেন আইভরি কোস্টের প্রত্যেককে।
আফ্রিকান এই ফুটবলার ক্যারিয়ারে শিরোপা জিতেছেন অনেক, তবে সবচেয়ে বড় শিরোপা হিসেবে জিতেছেন স্বজাতিসহ সকল ফুটবল প্রেমীর নি:শর্ত ভালবাসা। হয়ে ওঠেন যেন শান্তির প্রতীক! বিনম্র শ্রদ্ধা দিদিয়ের ‘দেবদূত’ দ্রগবার প্রতি।