স্কোরকার্ড বলছে, ‘সদগোপান রমেশ বোল্ড রঞ্জন দাস ৫৮।’
এই পরিসংখ্যানটুকু বাদ দিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁকে চেনার, জানার আর কোনও উপায় নেই। কী করেই বা থাকবে! সেই ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর-এর ভারত-বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট ম্যাচটাই যে তাঁর জীবনের প্রথম এবং শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তিনি বিকাশ রঞ্জন দাস।
দারুণ এক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন রঞ্জন। ১৮ বছর বয়সে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। সেটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক দিন। নাবালকত্ব ছেড়ে সাবালকত্বের পথে পা বাড়িয়েছিল পদ্মাপাড়ের ক্রিকেট। অনেকেই তখন বলেছিলেন, লম্বা দৌড়ের মশলা রয়েছে বিকাশের মধ্যে। ঠিকঠাক রাস্তা ধরে এগোলে বাঁ-হাতি পেসার সৌরভ ছড়াতেই পারতেন সে দেশের ক্রিকেটে।
কিন্তু যা ভাবা হয়, তা সব সময় মেলে না। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যেতে হয় বিকাশকে। ‘বিকাশ’ নামের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সে দিনের বিকাশ রঞ্জন দাস ব্যক্তিগত বিশ্বাসে বদলে ফেলেছেন ধর্ম। হয়ে গিয়েছেন মাহমুদুল হাসান রানা। ক্রিকেটারের পরিবর্তে এখন তিনি ব্যাংকের ম্যানেজার। ব্যস্ততার মধ্যে কাটে প্রতিটা দিন। টুকটাক কর্পোরেট ক্রিকেট খেলা ছাড়া বাইশ গজের সাথে তাঁর খুব বেশি সম্পর্ক নেই।
২০০০ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির দলের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট। ১৯ বছর বাদে সৌরভের আমন্ত্রণেই আবার এসেছিলেন ইডেনে। ভারত-বাংলাদেশের পিঙ্ক বল টেস্টের সময়ে। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আমাকে ভিডিও কল করেছিলেন বিকাশ রঞ্জন দাস। থুড়ি, মাহমুদুল হাসান। তাঁর পাশে বসেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক খালেদ মাসুদ। বিমানে ওঠার আগে বললেন, ‘দাদা, দেখা হবে। আমার এক আত্মীয় থাকেন কাঁকুড়গাছি। ওখানেও যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’
কলকাতায় অবশ্য বিকাশ রঞ্জন দাসের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। তাঁকে নিয়ে যে প্রতিবেদন আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে লিখেছিলাম, তার শিরোনাম ছিল, ‘ধর্ম বদলেছেন, ঢাকার সেই ঐতিহাসিক স্কোয়াডের অভিমানী ক্রিকেটার থাকছেন ইডেনে।’
অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকাশ রঞ্জন দাস আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, ‘দাদা, আমাকে নিয়ে কেউ এরকম আগে লেখেনি। আপনিই প্রথম।’ অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘শিরোনাম থেকে দয়া করে ধর্ম বদলেছেন ব্যাপারটা সরিয়ে দিন।’ বিকাশ রঞ্জন দাসের অনুরোধ রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
সবাই জানেন, ২০০০ সালে টেস্ট খেলার স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পড়াশোনা করা বিকাশ আজকে যিনি ঢাকার ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার, সেই তিনি তুলে নিয়েছিলেন সদাগোপন রমেশের উইকেট। বিকাশের জোরের উপরে ধেঁয়ে আসা বলটাই মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয় রমেশের কাছে।
একটু জোরের উপরেই বলটা রেখেছিলেন বিকাশ। বাড়তি বাউন্সে বল রমেশের ব্যাটে লেগে স্টাম্পে লাগে। একটু পরেই আম্পায়ার স্টিভ বাকনার এগিয়ে এসে বিকাশের হাতে বেলটা তুলে দেন। বিকাশকে বলেন, ‘এটা যত্ন করে রেখে দিও। এটা তোমার প্রথম টেস্ট উইকেটের স্মৃতি।’ বেলটা হাতে নিয়ে বিকাশ দেখেন তা ভেঙে গিয়েছে।
সেই বেল এখনও বিকাশের শো কেসে সযত্নে সাজানো রয়েছে। অভিষেক টেস্টের সেই স্মারকের দিকে তাকালে অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করে তাঁর। সেই সঙ্গে যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে তাঁর বুক। শুরুতেই কেন শেষ হয়ে গেল প্রতিশ্রুতি জাগানো একটা ক্যারিয়ার?
ঘরোয়া ক্রিকেটে নাগাড়ে বল করে যেতেন। পিঠে ব্যথা অনুভব করতেন। কেউ সে ভাবে গাইড করার ছিল না। ওই পিঠের চোটই ক্যারিয়ার শেষ করে দিল দারুণ এক সম্ভাবনার।
চোট তো অনেক ক্রিকেটারই পান। তাঁরা আবার ফিরেও আসেন। যেমন হার্দিক পান্ডিয়া। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মারাত্মক চোট পেয়ে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছেড়েছিলেন। সেই দুবাইয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই হার্দিক পান্ডিয়া এবার ফেরেন ম্যাচ উইনার হয়ে। মাঠে ফেরার জন্য পান্ডিয়ার পাশে থেকেছে ভারতীয় বোর্ড।
কিন্তু বিকাশের অভিমান, তাঁর দিকে সেই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), তখন বিসিবির এসব বিষয়ে বোঝাপড়া, সঙ্গতি বা স্বদিচ্ছার ঘাটতি ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ ব্যাংক টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে শচীন টেন্ডুলকার ও অজিত আগারকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। জানতে পারেন চোট সারানোর জন্য বোর্ড ওদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে। বিকাশও বাংলাদেশ বোর্ডের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দু:খের কথা, কোনও সহযোগিতাই পাননি। বিকাশের আফসোস, ‘তখন ঠিকঠাক সাহায্য পেলে আমাকে হয়তো খেলা ছাড়তে হত না।’
২০০৪-০৫ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এবং ক্লাব ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যান রানা। তখন সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ফাস্ট বোলিং ছেড়ে বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। যদিও তাঁর এই নতুন রূপ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এবং সময়ের স্রোতে বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে যান তিনি।
করোনার আগে পিঙ্ক বল টেস্ট কলকাতাকে তিলোত্তমা করে তুলেছিল। নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ইডেনে। ভরা ইডেন আবেগতাড়িত করে তুলেছিল বিকাশকে। ফিরিয়ে দিয়েছিল ১৯ বছর আগের সোনা রোদ্দুর। ভারত-বাংলাদেশ খেলা দেখতে দেখতে বিকাশের চোখে ভেসে উঠছিল, ১৮ বছরের এক তরুণ প্রতিভা বল হাতে ছুঁটছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। তাঁর বিষাক্ত ছোবলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রমেশের উইকেট।
কে বলে ক্রিকেট কেড়ে নেয়! মন ভাল করা অনেক স্মৃতিও তো ফিরিয়ে দেয় ক্রিকেট।