সুধীর নায়েক, দু’জোড়া মোজা কিংবা মুম্বাইয়ের গল্প

চার দিনের ওয়ানডে ক্যারিয়ার আর ছয় মাসের টেস্ট ক্যারিয়ারের চেয়ে হয়ত একটু বেশি যোগ্যতা ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫ তারিখে মুম্বাইতে জন্মানো সুধীর সখারাম নায়েকের। কিন্তু দুটি ওডিআই খেলে ৩৭ রান আর তিনটি টেস্ট খেলে একটি অর্ধশতরানসহ ১৪১ রান (সর্বোচ্চ ১৯৭৪ সালে বার্মিংহাম টেস্টে ৭৭ রান) করা ফ্রেমের তুলনায় অনেক বেশি আলোচিত থেকে গেছেন তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে, মাঠের বাইরের একটি ঘটনার জন্য।

অথচ তার প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের সাতটি শতরান আর ২৭ টি অর্ধশতরানসহ ৪৩৭৬ রান (সর্বোচ্চ অপরাজিত ২০০) করেছিলেন সুধীর নায়েক। বরোদার বিরুদ্ধে ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে ওই অপরাজিত ২০০ ছিল রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর সর্বোচ্চ রান। রঞ্জি ট্রফিতে ৪০.১০ গড়ে তার মোট রান ছিল ২৬৮৭। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়া সারদেশাই-সোলকার-গাভাসকার-মানকাদবিহীন বোম্বাই হীনবল হয়েও রঞ্জী ট্রফি জিতেছিল সুধীর নায়েকের অসাধারণ নেতৃত্বে।

ডি জি রুপারেল কলেজের জৈব রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী সুধীর নায়েক খেলা শুরু করেছিলেন মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে। পরে টাটা অয়েল মিলসে চাকরি পান অরগানিক কেমিস্ট হিসেবে। সে সময় টাটা অয়েল মিলসের ক্রিকেট টিমের অধিনায়কের নামও ছিল সুধীর নায়েক।

১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ড সফরকারী ভারতীয় দলের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচগুলিতে ৪০.৫৫ গড়ে ৭৩০ রান করেছিলেন তিনি, যা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো ছিল। এর ফলেই ওপেনার স্লটে দরজা খুলেছিল বার্মিংহামের পঞ্চম টেস্টে। ১৯৭৪ সালে বার্মিংহাম টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৭ রান করেছিলেন চাপের মুখে, ওল্ড-আর্ণল্ড-হেনড্রিক্স-আন্ডারউডের বিরুদ্ধে রীতিমত লড়াই করে। ওই যে আগে বলেছি, ইংল্যান্ডে মাঠের বাইরের সেই ঘটনাটি ঘটেছিল তার কয়েকদিন আগেই। গোপাল বসুকে বসিয়ে তাঁকে বার্মিংহামে টেস্টে খেলানো নিয়ে বিতর্ক অবশ্য আজও জীবন্ত।

আর এর জন্যই আর মাত্র দু’টি টেস্ট দীর্ঘায়িত হয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ার। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মার্ক অ্যান্ড স্পেনসার-এর দোকান থেকে দু’জোড়া মোজা চুরির দায় নিতে হয় তাঁকে। উইকির কথা অনুযায়ী, ‘He pleaded guilty under pressure from the Indian Government and BCCI. Back home he played in two more Tests against West Indies. This turned out to be his last season played for India.’

মার্ক অ্যান্ড স্পেনসার-এর দোকানের আসল ঘটনা আজও কুয়াশা ঢাকা, কিন্তু দিনের আলোর মত স্পষ্ট ছিল ১৯৭৪ সালের ওই ঘটনা নিয়ে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়দের দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া। যখন সুধীর নায়েকের রুমমেট হওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সানি নিজে এগিয়ে এসে তার রুমমেট হয়েছিলেন।

ওই ট্যুরে ভারতীয় দলের সদস্য সুনীল গাভাস্কার বিশ্বাস করতেন যে সুধীর নায়েক নির্দোষ ছিলেন এবং তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সে বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় ছিল যে আজ প্রায় ৪৯ বছর হয়ে গেল, মার্ক অ্যান্ড স্পেনসার-এর কোন দোকান থেকে কোন কেনাকাটা করেন নি সানি, সেদিন থেকে আজ অবধি।

হঠাৎ ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া সুধীর নায়েক পরে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড ইনচার্জ কাম চিফ কিউরেটর হওয়ার আগে ন্যাশনাল ক্রিকেট ক্লাব অফ মুম্বাইর কোচ ছিলেন। তার কোচিংয়ে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জহির খান, ওয়াসিম জাফর, রাজেশ পাওয়ার, পরশ মামব্রে প্রমুখ। ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালের বহু প্রশংসিত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচ বানানো হয়েছিল তারই তত্ত্বাবধানে। এছাড়াও বিসিসিআই-র গ্রাউন্ড অ্যান্ড পিচ কমিটির পশ্চিমাঞ্চল ইনচার্জ ছিলেন তিনি।

সপ্তাহখানেক ধরে গুরূতর অসুস্থ ৭৮ বছর বয়সী সুধীর নায়েক মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন থাকার পরে চলে গেলেন ২০২৩-এর পাঁচ এপ্রিল। মৃত্যুও হয়তো তাঁকে নিয়ে কোনো কাব্যের উদ্রেক ঘটাবে না, এতটাই আড়ালে ছিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link