এক সাংবাদিক তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘রাস্তায় তাঁকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে, বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত, যেকোনো ধরণের কায়িক পরিশ্রমবিমুখ অবসরপ্রাপ্ত, সিগার খোর ব্যবসায়ী।’ অনেকে তাঁর বিশাল বপুর কারণে তাঁকে বলতেন, ‘লেভিয়াথান’।
প্রসঙ্গত বিভিন্ন পুরাণে এক সুবিশাল সামুদ্রিক জন্তুকে লেভিয়াথান বলে ডাকা হতো। তবুও তাঁর ক্রিকেট জীবনের ব্যাপ্তি ছিল আড়াই দশক। এবং ২৬৯ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তিনি প্রায় ৪৭ গড়ে ১৬০০০ রান এবং ১৯ গড়ে ৮৩২ উইকেটের কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। এই ২৬৯ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৫০টি টেস্ট ম্যাচও ছিল। তিনি ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং। জন্মেছিলেন ১৮৭৯ সালের ২২ মে।
মোটামুটি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগের সময়টাকে ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বলে থাকেন। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে যখন বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের দামামা পুনরায় বেজে উঠলো, তখন ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই বলতেন, ‘স্বর্ণযুগের মতো ক্রিকেট আর এখন নেই। এখন সব ক্রিকেটারই যেন একই রকম। খেলা তো হতো স্বর্ণযুগে। এক এক জন ক্রিকেটার তো শুধু ক্রিকেটার নন, এক এক জন চরিত্র।’
কিন্তু ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং সম্পর্কে এইরকম কোনো অপবাদ শোনা গেছে বলে জানা যায় না। কারণ তাঁর মতো ‘চরিত্র’ টেস্ট ক্রিকেট আগেও কম দেখেছে, পরেও কম দেখবে। বরাবরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী আর্মস্ট্রং রয়ে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার হয়ে। ১৯১৯-২০ মরসুমে, ৪০ বছর বয়সে, আর্মস্ট্রং ৫২ বার ব্যাট করেন এবং ৫৪২০ টি বল করেন।
এই কীর্তির ব্যাপ্তি বোঝার জন্যে একটি ছোট্ট তথ্য দি। ১৯৯৯-০০ মরসুমে, স্টিভ ওয়া ৪২ বার ব্যাট করেন ও শেন ওয়ার্ন ৪৫৭২টি বল করেন। ১৩৩ কেজি ওজন, দুবার ম্যালেরিয়ার আক্রমণ, এতো সবকিছুর পরেও ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং ছিলেন সাচ্চা অলরাউন্ডার। আজকের ইয়ো-ইয়ো টেস্ট ও পেশীবহুল ফিটনেসের সংজ্ঞায় আর্মস্ট্রং ছিলেন চরম আনফিট। কিন্তু ওয়াসিম আকরাম একটা কথা খুব বলতেন-ক্রিকেট ফিট। আর্মস্ট্রং ছিলেন তাঁর চলমান সংজ্ঞা।
১৯১২ সালের ইংল্যান্ড সফর প্রত্যাখ্যান করেন অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে ঝামেলা করে। ক্রিকেট ইতিহাসে ‘বিগ সিক্স’ বিপ্লবী যাঁদের আখ্যা দেয়া হয় সেই ছয়ের দলে আর্মস্ট্রং ছিলেন একজন। ট্রাম্পার ও ক্লেম হিলও ছিলেন সেই দলে। এঁদের মধ্যে, একমাত্র ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের ক্রিকেট জীবন এই ঘটনার পরও দীর্ঘায়িত হয়েছিল। আজ সেই ঘটনার এতো বছর পরে লিখতে বসে ভাবি, কিভাবে?
চিরকালীন প্রতিষ্ঠান বিরোধী তিনি কিভাবে স্রেফ ক্রিকেট বোর্ডের চাকুরে হয়ে খেলে গেছেন? কিন্তু এই কারণেই তিনি আর্মস্ট্রং। তিনি চাকুরে হয়েও তাঁর ব্যক্তিত্ব মালিকসম। লালমোহন বাবুর ভাষায়, ‘ব্যক্তিত্ব উইথ এ ক্যাপিটাল বি।’ অবশ্য শুধু দিনগত পাপক্ষয় নয়, খেলেছেন রীতিমতো সাফল্যের সঙ্গে। ১৯২০-২১ সালে যেবার এশেজ সিরিজে প্রথম বার হোয়াইটওয়াশ হয় ইংল্যান্ড, সেবার অধিনায়ক ছিলেন আর্মস্ট্রং। এবং শুধু নাম-কে-ওয়াস্তে অধিনায়ক নন।
ব্যাটে-বলে নেতৃত্ব দিয়ে গেছিলেন সেবার। তিনটি সেঞ্চুরি সমেত ব্যাটে তাঁর গড় ছিল ৭৭। বলে ২২। এরপর ইংল্যান্ড সফরে ১৯২১ এর এশেজে, আর্মস্ট্রংয়ের অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে হারায় ৩-০। পরপর আটটি এশেজ টেস্ট জেতার রেকর্ড আজ অব্দি আর কোনো অধিনায়কের নেই। এবং আশ্চর্য্যের ব্যাপার, তিনি অধিনায়কত্ব করেছেন ওই দশটি অ্যাশেজ টেস্টেই।
খুব ঝুঁকে ব্যাট ধরতেন আর্মস্ট্রং। এক সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘আর্মস্ট্রংয়ের হাতে ব্যাটটিকে মনে হতো একটি চা-চামচ। ওই চামচ দিয়েই যেন চায়ে চিনি গোলার মতো বোলারদের গুলে দিতেন।’ অনেক পন্ডিতই লিখে গেছেন, আর্মস্ট্রংয়ের ব্যাটিং খুব একটা উপভোগ্য নয়। তাঁর লেগব্রেক বোলিংয়েও ওয়ার্নের মাদকতা নেই। তিনি রাউন্ড দি লেগ বল করতেন শুধু রান বাঁচানোর জন্যে।
তিনি নাকি এতোটাই ঘামতেন যে ব্যাটিং ক্রিজে একটা ছোটখাটো সুইমিং পুল তৈরি হয়ে যেত। এতো কিছুর পরেও, আর্মস্ট্রং এতো প্রণম্য ক্রিকেটার হয়ে রয়ে গেছেন তাঁর একটাই কারণ। তাঁর চরিত্রের বলিষ্ঠ হীরকদ্যুতি দর্শককে এতটাই আসক্ত করে রেখেছে যে তাঁর ক্রিকেটের ছোটখাটো সীমাবদ্ধতার প্রতি অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে দৃষ্টিপাত করার কথা তাঁদের মাথায় আসে না। অধিনায়ক হিসাবে গেমসম্যানশিপের দারুন প্রয়োগ করতেন আর্মস্ট্রং।
একবার ফ্র্যাঙ্ক উলি কে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রাখেন। সে সময়ে ক্রিকেটে ট্রায়াল বল করার রেওয়াজ ছিল। পাশের পিচে পনেরো মিনিট ট্রায়াল বল করে করে ফ্র্যাঙ্ক উলিকে অতিষ্ঠ করে দেন। আরেকবার স্লিপে একটি ক্যাচ ধরে আম্পায়ারের কাছে আবেদন করেন ওভারের শেষ বলে। আবেদন নাকচ হয়ে যায়। পরের ওভার শুরু হবার সময় আম্পায়ারের কাছে জানতে চান, ‘আউটটা কেন দিলেন না?’ আম্পায়ার বলেন, ‘আরে বল তো ব্যাটেই লাগেনি। প্যাডে লেগেছে।’
আর্মস্ট্রং পাল্টা জবাবে বললেন, ‘তাহলে লেগ বিফোর উইকেট চাইছি।’ আম্পায়ার সাথে সাথে আউট দিলেন। আউট হওয়া ব্যাটারের মানসিক অবস্থা ঠিক কেমন হয়েছিল, সেটা উপরওয়ালাই জানেন।
ক্রিকেট ছাড়ার পর আর্মস্ট্রং সাংবাদিকতা করেছেন। ‘ফ্র্যাঙ্ক এন্ড ফিয়ারলেস’ বলে একটি কলাম লিখতেন নিয়মিত। তিনি মনে করতেন, টেস্ট ক্রিকেট সবসময় ফলাফল অব্দি খেলা হওয়া উচিৎ। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অবশ্য একটু বেশিরকম সমালোচনা করতেন আর্মস্ট্রং। যেটি অনেক সাবেক ক্রিকেটারই করে থাকেন, ‘এখনকার বাচ্চারা আর কি খেলে, খেলা তো হতো আমাদের সময়ে।’
তবুও ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং থেকে যাবেন ক্রিকেটের আকাশে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে। ভবিষ্যতের ক্রিকেটার হয়তো ইয়ো-ইয়ো টেস্ট পাশ না করতে পারার দুঃখে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকবেন। ঠিক তখনই তাঁকে কেউ রণতুঙ্গা, ইনজামাম, কর্ণওয়ালের পাশাপাশি আর্মস্ট্রংয়ের গল্পও শোনাবেন। ক্রিকেট বড়ো দরিদ্র খেলা। ক্রিকেটের নিল আর্মস্ট্রং নেই। কিন্তু ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং তো আছেন !