বাইশ গজের অধ্যায় থেকে সবার হয়েছে প্রস্থান। কিন্তু তিনি রয়ে গিয়েছেন রাজসিক মুহূর্ত সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। অর্জনে, গর্জনে, গৌরবে এরই মধ্যে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন কিংবদন্তিতূল্য আসনে। তবুও যেন তাঁর যাত্রা থামবার নয়।
শত অর্জনেও অতৃপ্ত থাকেন যিনি। কারণ ঐ অতৃপ্ততাই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে উঠতে এতকাল উন্মত্ত ভূমিকা রেখেছে। এই তিনি টা কে? তিনি সাকিব আল হাসান, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হবু অধিনায়ক।
এত সব বিশেষণের মধ্যে প্রথম লাইনটাই বোধহয় তালগোল পাকিয়ে দিল। না। জটিল কথার বেড়াজালে না গিয়ে একটু সরলযোগ্য করা যাক কথাটা। ২০১১ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন সাকিব আল হাসান।
কিন্তু জানেন কি, ১৪ দলের অংশগ্রহণে সেবারের বিশ্বকাপের ১৪ অধিনায়কের মধ্যে ১৩ জনই এবারের বিশ্বকাপে থাকছেন না। আছেন শুধু সাকিব আল হাসান।
১২ বছরের ব্যবধানে এবারের বিশ্বকাপে দলসংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০-এ। দুই বারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবারের বিশ্বকাপে মূল পর্বে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ২০১১ বিশ্বকাপে তাদের অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট ছেড়েছেন বহুদিন হল। দুই বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী এ অধিনায়ক দায়িত্ব পালন করছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের প্রধান কোচ হিসেবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো এবারের বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়েও। ২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড। আর জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এলটন চিগুম্বুরা।
১২ বছর বাদে, যখন আরেকটি বিশ্বকাপ দোরগোড়ায়, তখন দুজনই এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অতীত। চিগুম্বুরা জিম্বাবুয়ের জার্সিকে বিদায় জানিয়েছেন ২০২০ সালে। আর পোর্টারফিল্ড অবসর নিয়েছেন ২০২২ সালে।
২০১১ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে যখন রিকি পন্টিং নেতৃত্ব দিলেন, তখনই ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ছিলেন তিনি। দু’বছর বাদে সেটিই হয়েছে। ২০১২ এর শেষ দিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানায় অস্ট্রেলিয়ার দুই বারের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক রিকি পন্টিং।
পন্টিংয়ের মতো ঐ বিশ্বকাপের পরের বছরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সেবারের অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস। অবশ্য অবসরের পরে এখন ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের সাথেই আছেন তিনি।
ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ১০৮ টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ। ২০১১ বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের নেতৃত্ব দেওয়া এ ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান ২০১৪ সালে।
আর এর এক বছর পরেই, ২০১১ তে নিউজিল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেওয়া ডেনিয়েল ভেট্টোরি বিদায় জানান। ক্রিকেট থেকে বিদায়ের পর অবশ্য কোচিংয়ের সাথেই আছেন তিনি। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আইপিএলের দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বোলিং কোচ ছিলেন তিনি।
একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ দলেরও স্পিন বোলিং কোচ ছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এই ভেট্টোরির সাথে এক সময় সেরা বোলারদের র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান নিয়ে সাকিবের সাথে টক্কর। পরবর্তীতে, সেই সাকিবেরই গুরু হয়েছেন তিনি।
নেদারল্যান্ডসকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন পিটার বোরেন। কিন্তু তিনি ক্রিকেট ছেড়েছেন, তা প্রায় বছর পাঁচেক হতে চললো । কানাডাকে সেবার নেতৃত্ব দেওয়া আশিস বাগাই তো ক্রিকেটেই নেই, প্রায় এক দশক হতে চললো।
এ ছাড়া, কেনিয়ার কাপ্তানি করা জিমি কামান্ডে এখন ক্রিকেটে ছেড়ে পুরোদস্তুর কোচ হয়ে উঠেছেন। কেনিয়া অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ক্রিকেটের চিরসবুজ কাকে বলা যেতে পারে? অনেকেই যুক্ত হতে পারে সে তালিকায়। তবে পাকিস্তান শহীদ আফ্রিদির নামটাই বোধহয় অগ্রগণ্য হবে আগে। এই কিছুদিন আগেও কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেললেন।
যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে তিনি বিদায় বলেছেন ২০১৭ সালেই। তো, ২০১১ বিশ্বকাপে ১৪ অধিনায়কের একজন ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সেবার সেমিতে গিয়েছিল তাঁর কাপ্তানিতেই।
২০০৭ এর রানার্সআপ শ্রীলঙ্কার দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি হয় ২০১১ সালেও। ভারতের কাছে ফাইনাল হেরে শিরোপা স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় তাদের। সেবার লঙ্কানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলন কুমার সাঙ্গাকারা। এরপরে অবশ্য সাঙ্গাগারা ২০১৫ বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন।
টানা ৪ সেঞ্চুরিতে করেছিলেন রেকর্ড। কিন্তু সেটিই ছিল তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ টুর্নামেন্ট। এই মুহূর্তে আইপিএলের দল রাজস্থান রয়্যালসের কোচিং স্টাফের অন্যতম সদস্য তিনি।
ফাইনালের আরেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও এখন আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেই। ২০১৯ বিশ্বকাপই হয়ে গিয়েছে ভারতের জার্সিতে তাঁর শেষ স্মৃতি।
২০১১ বিশ্বকাপে ১৪ অধিনায়ক নিয়ে আইসিসির একটি অফিশিয়াল ফটোসেশন হয়েছিল। সে ছবি নিশ্চয়ই এখনো স্মৃতির খোরাক অনেক ক্রিকেটমোদীদের কাছে। তবে সাকিব এখনও বাইশ গজে অতীত হয়ে যান নি। বাকি ১৩ অধিনায়ককে এখন ধূসর রঙে চিহ্নিত করলেও, সাকিব এখনও রয়েছেন রঙিনই।
আপাতত সম্ভাবনা যা বার্তা দিচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপে ১০ অধিনায়কের ফটোসেশনে থাকতে পারেন সাকিবও। ২০১১ বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়কদের মধ্যে যিনিই শুধু থাকবেন সে ফ্রেমে।
সাকিবকে অবশ্য এমন অর্জন না ছোঁয়ারই কথা। কারণ বাংলাদেশের বিশ্বজয়টাই তাঁর কাছে মূখ্য ব্যাপার। হবে নাকি এবারে একটা বিশ্বজয়? সাকিব নিজেও এই উত্তরটা জানেন না। তবে বিশ্বকে জানান দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর মধ্যে রয়েছে। সাকিব নিশ্চয় সেই লক্ষ্যেই ছুটছেন। যেভাবে তিনি দুরন্ত গতিতে দীর্ঘ ১৭ টা বছর বাইশ গজে নিজের সিংহাসনটা অক্ষত রেখেছেন।