ময়না পাখির গান থেকে বাঘের গর্জন

বিকেএসপির দিনগুলোতে নাঈম ইসলাম হঠাৎ একদিন বলেছিলেন, ‘আরে, এই ছেলে তো ময়না পাখির মতো কথা বলে!’ আর সেই থেকে শুরু হয় ‘ময়না’র গল্প। যে ময়না পাখির সুরেলা গান আজও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কানে বাজে।

২০০৬, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। বিশ্বকাপের আগে গুছিয়ে উঠছে বাংলাদেশে দল। বাঁ-হাতি স্পিন অলরাউন্ডার নতুন নয়; মানজারুল ইসলাম রানা আছে, মোহাম্মদ রফিক আছে, আব্দুর রজ্জাক আছে। আর ওই উনিশের ছেলেটি? হ্যাঁ, সাকিব আল হাসান, ওরফেম ময়না। প্রথমে কোনো বিশেষ প্রত্যাশা নেই। প্রস্তুতি ম্যাচে হাবিবুল বাশার সুমনও বিশেষ কিছু দেখলেন না।

কিন্তু শেষ ম্যাচে—একটি উইকেট বোলিংয়ে, অপরাজিত ৩০ রান ব্যাটে—সব কিছু বদলে যায়। বাশার অবাক চোখে দেখেন, ‘এই ছেলেটা অন্যরকম। সেদিন থেকেই সাকিব দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কে জানত, ময়না পাখির গান একটা বাঘের গর্জন হয়ে উঠবে বিশ্বমঞ্চে।

২০০৭ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ, ত্রিনিদাদ। বল হাতে দুটো উইকেট, ব্যাটে হাফ সেঞ্চুরি। এরপরের তিন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেও হাফ সেঞ্চুরি—বিশ্বে একমাত্র এই রেকর্ডের মালিক সাকিব।

টেস্টে ভারতের বিরুদ্ধে, প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো—সব জায়গাতেই অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স। বাংলাদেশের কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি সবসময় আছেন। রান করতে হবে? সাকিব আছেন। উইকেট লাগবে? সাকিব আছেন। অধিনায়কত্ব? সে তো সাকিবের জন্য ডালভাত।’

২০০৬ থেকে ২০২৪, ১৮ বছর ধরে ধারাবাহিকতা—এমন খেলোয়াড় বিরল। ব্যাটে, বল হাতে, কখনও কখনও দুই দিকেই—বাংলাদেশকে কঠিন যুদ্ধে জয় এনে দিয়েছেন। মিরপুরের মাঠ হোক বা অস্ট্রেলিয়ার কঠিন টেস্ট, ভারতের চ্যালেঞ্জ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মরণবাঁচন ম্যাচ—সাকিব সবসময় প্রস্তুত। ২০১৯ বিশ্বকাপে একা বাঘ হয়ে তিনি যেভাবে বিশ্ব শাসন করেছেন, সেটা দেখে অবাক বিস্ময় আসতে বাধ্য।

খুলনার মগুরায় জন্ম, যুব দলের ঝোড়ো সেঞ্চুরি, জাতীয় দলে ডাক। সাদা বলের ক্রিকেটে ব্যাটিং অলরাউন্ডার, লাল বলের ক্রিকেটে বোলিং অলরাউন্ডার। ২০০৮ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে বোলিংয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালে ২ রানের হারের বেদন। প্রতিটি মুহূর্তে সাকিব ছিলেন দলের ভরসা।

বিশ্বকাপ, টেস্ট, টি-টোয়েন্টি—তিন ফরম্যাটেই এক নম্বর অলরাউন্ডার। একদিনের ক্রিকেটে বর্ষসেরা অলরাউন্ডার, উইজডেনে ২০০৯ সালের বর্ষসেরা। সাকিব মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবিচল সাফল্যের প্রতীক। মাঝে ফিক্সিংয়ের বিষ ঢুকল, সাকিব মাঠের বাইরে গেলেন। ফিরলেন রাজার বেশি।

ময়না পাখি সুরের মতো, সাকিবও মাঠে গান গাইতে জানেন। কখনো ব্যাটে, কখনো বল হাতে। কখনো টার্গেট পূরণে, কখনো উইকেট শিকারে। তিনি ব্যাটে-বলেই নেতৃত্ব দেন, বাংলাদেশের হয়ে আজকাল তাঁকে আর দেখা না গেলেও ফ্র্যাঞ্চাইজির দুনিয়ায় তাঁর আবেদন কমে যায়নি।

৭৫ নম্বর জার্সিটা শেষবারে তুলে রাখার আগে, আবারও ময়না পাখির গান বাজবে, আবারো বাংলাদেশের মাঠে বাজবে সাকিবের ছন্দ। ক্রিকেটের ময়না, বাংলাদেশের বাঘ শেষ সুযোগ পাবেন কি না সেটা কেউ জানে না। তবে, বাইরের সকল আলোচনা ভুলে এটাই সত্যি যে, ‘ময়না’ নামের মিষ্টি হাসির ছেলেটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিকারের বাঘ।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link