অখ্যাত থেকে অতিমানব

রিভার প্লেটের মার্সেলো গ্যালার্দো বিশ্ব ফুটবলে এখনো অত বড়ো নাম নয়। তারপরেও ২০১৮ সালের জঘন্য বিশ্বকাপের পরে আর্জেন্টিনার কোচ হবার দৌড়ে তার নামটাই এগিয়ে ছিল। আর দুই নামডাকওয়ালা পচেত্তিনো আর সিমিওনে তো ছিলোই। কিন্তু আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন বেঁছে নিল অজ্ঞাত এক লিওনেল স্ক্যালোনিকে।

অবশ্য পচেত্তিনো, সিমিওনেকে আনার সামর্থ্যও ছিল না আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের। তাই তখনকার কোচ সাম্পাওলির এসিস্ট্যান্ট স্ক্যালোনিই ছিল একমাত্র ভরসা। কোচ হিসেবে স্ক্যালোনি পেয়েছিল বুড়িয়ে যাওয়া এক দলকে। আনকোরা কোনো কোচের জন্যে এমন দলকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, ভাল ফুটবল খেলা এক প্রকার অসম্ভব।দু:স্বপ্নকে এড়ানো যাচ্ছিল না কিছুতেই। আবারো ব্যর্থতা আর্জেন্টিনা দলের। ২০১৯ কোপার সেমিতে বিদায়, তাও আবার ব্রাজিলের কাছে। স্ক্যালোনির সামনে বিশাল চাপ। নিজের অস্তিস্ত্বের সংকট।

একলাফে একটু সামনে চলে আসি।সময়টা ২০২২ সাল। কোভিড মহামারিতে বিশ্বের সবকিছু থমকে গিয়েছিল মাঝের দুই বছর।আর্জেন্টিনা আরামসে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের মূলপর্বে। দলের ডাগআউটে এখনো আছে সেই অজ্ঞাত লিওনেল স্ক্যালোনি।শুধু আছে বললে অন্যায় হয়ে যাবে। রাজকীয় হালেই আছে। আর্জেন্টাইন মিডিয়ায় স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনা দলকে ডাকা হয় ‘লা স্ক্যালোনেতা’ নামে। হ্যা,ঠিকই ধরেছেন স্ক্যালোনির দল, তার নামেই ডাকনাম।এমনটাই হয়েছে। স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনা দলটি এখন পর্যন্ত ৩১ ম্যাচে অপরাজিত। গত ৩০ বছরের মধ্যে সেরা এই রেকর্ড।

স্ক্যালোনির আসল মাহাত্যের কথা এখনো বলা হয়নি। বিলম্ব করলাম। ইচ্ছা করেই। বা আমার লেখার ধরনই এমন। মূল জিনিসে আসতে দেরি করি। জীবনের মতন। সিরিয়াস হয়েও হই নি। তবে স্ক্যালোনির জন্যে লেখা লিখতেছি অন্তরের অন্তস্থল থেকে। সকল ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে। আর্জেন্টিনাকে স্ক্যালোনি যা দিয়েছেন তা পারেননি মার্সেলো বিয়েলসা,জোসে পেকারম্যান, আলেহান্দ্রো সাবেলা, টাটা মার্টিনোর মতন নামীদামী কোচরাও।

স্ক্যালোনি আর্জেন্টিনাকে আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতিয়েছেন। দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘুচিয়েছেন।লিওনেল মেসিকে দিয়েছেন জাতীয় দলের হয়ে অধরা শিরোপার স্বাদ। ব্রাজিলকে তাদেরই মারকানাতে হারিয়ে আর্জেন্টিনা জিতে নেয় নিজেদের ১৫ তম কোপা আমেরিকা। ১০ জুলাই সেদিন আর্জেন্টিনার সব ছিল,শুধু ছিল ম্যারাডোনাই।শিরোপাটা ম্যারাডোনার, মেসির, আর্জেন্টিনার এবং স্ক্যালোনির।

আর্জেন্টিনার অপয়া সময়ের শুরু ১৯৯৩ সালের কোপা জয়ের পর থেকে। ৬ টা ফাইনাল হেরেছে আকাশি-সাদারা।অবশেষে মারাকানায় এসে ফাইনাল জয় হলে। আর্জেন্টিনার হয়ে ৪ ফাইনাল হারা মেসির উপরেই সব আলো পড়েছিল ফাইনাল জয়ের পর। কিন্তু এই ফাইনাল জয়ের আনসাং হিরো কোচ স্ক্যালোনিই।

নম্র মানুষ স্ক্যালোনি ম্যাচ শেষের প্রেস কনফারেন্সে এসে বলেছিলেন তার জায়গায় যেই থাকতো সেই এই শিরোপা জিততো, স্কোয়াডের সব (২৮জন) প্লেয়ারদের যোদ্ধা বলে প্রশংসা বাক্যে ভাসিয়েও দিলেন। স্ক্যালোনির আনকোরা এক প্লেয়ার/ কোচ থেকে জাতীয় বীরে পরিণত হওয়া যেন রুপকথার গল্প।১৯৯৭ সালে যুব বিশ্বকাপে স্ক্যালোনির সতীর্থ ছিলেন ওয়াল্টার স্যামুয়েল আর পাবলো আইমার, এই দুইজনই আছেন স্ক্যালোনির কোচিংস্টাফেও।

স্ক্যালোনির কোচ হিশেবে আর্জেন্টিনা অধ্যায়ের শুরুটা ভাল ছিল না। আর্জেন্টাইন ফুটবল লিজেন্ড হাভিয়ের মাশ্চেরানো বিদায় জানালেন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে। তার সাথে যোগ দিল গঞ্জালো হিগুয়েন। বুড়িয়ে যাওয়া মার্কোস রোহো, এভার বানেগা, গ্যাব্রিয়েল মার্কেদোদের দল থেকে বাদ দেন কোচ। দলের মিডফিল্ডের দায়িত্ব দিলেন রদ্রিগো দি পল,লিয়ান্দ্রো পারেদেস আর জিওভান্নি লো সেলসোকে।

আক্রমণে মেসির সহযোগী লাউতারো মার্টিনেজ। আর্জেন্টাইন ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছোট ছোট পাসে আক্রমণে যাওয়া ট্যাক্টিসকেও ছুড়ে ফেলে দেয় স্ক্যালোনি। এই ক্ষেত্রে নিজের মতের গুরুত্ব তার কাছে সবার আগে। দলের সবাইকে বললেন দ্রুত ডিফেন্স থেকে অ্যাটাকে যেতে হবে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়ার এই ট্যাক্টিস অবলম্বন করে সাফল্যের নকশা।

কেয়ারটেকার ম্যানেজার থেকে স্ক্যালোনি হয়ে গেলেন পার্মানেন্ট ম্যানেজার। সামনে ঘরের মাঠে কোপা আমেরিকা।কিন্তু কোভিড মহামারির জন্যে ২০২০ সালের কোপা আমেরিকা চলে গেল ২০২১ সালে আর আয়োজনের দায়িত্ব পেলেন ব্রাজিল ,যাদের করোনা পরিস্থিতি আর্জেন্টিনা কিংবা কলম্বিয়ার চেয়ে মোটেও ভাল ছিল না। আর্জেন্টিনার গোলে দায়িত্ব পেলেন হুট করে ক্লাব ফুটবলে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা এমি মার্টিনেজ, যার সামনে ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো নামের তরুন তুর্কি।

মিডফিল্ড আর অ্যাটাকের কথা আগেই বলেছি। আর্জেন্টিনার শুরুটা চিলির সাথে ১-১ এ ড্র করে। পরের দুইম্যাচে দুই গুয়ে উরু আর প্যারার বিরুদ্ধে ১-০ গোলের জয়। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় যেগুলোকে ‘কোতাইয়া কোতাইয়া’ জয় বললেও ভুল হবে না। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বলিভিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে স্ক্যালোনির দল যেন স্বস্তি দিল সকল ভক্তদের।কোয়াটার ফাইনালে ইকুয়েডরে বিপক্ষে ৩-০ গোলের সহজ জয়।সেমিতে টাইব্রেকারে কলম্বিয়াকে ৩-২ এ হারিয়ে ফাইনালে টিম আর্জেন্টিনা।

তিন পেনাল্টি ঠেকিয়ে নায়ক এমি মার্টিনেজ। মারাকানার ফাইনালে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপায় স্পর্শ।দল হিশেবে আর্জেন্টিনা ছিল বেশ সলিড। বিশেষ করে গোলি এমি মার্টিনেজ যেন স্বয়ং ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত কোনো আশির্বাদ। বাকি কাজটা নিরবেই সেরেছেন টুর্নামেন্ট সেরা মেসি।

স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে যেকারো।দলটা অসম্ভবভাবে একসুতোয় বাঁধা।নেই কোনো ইগো,যেটি আর্জেন্টিনার আগের দলগুলোতে বেশ দৃঢ়ভাবে ছিল।এই দলের সবাই যেন যথার্থভাবে বুঝে এবং পালন করেছে ‘পার্সোনাল এন্ড কালেক্টিভ রেস্পনসিবিলিটি’। সময়ানুযায়ে নেতার ভূমিকায় ছিলেন এমি মার্টিনেজ,রোমেরো, দি পলরা।

এই দলটার পরিবেশ যেন বদলে দিয়েছে অধিনায়ক মেসিকেও। নিজেকে নতুন করে জন্ম দিয়েছেন মেসি।খেলেন মনের আনন্দে,উপভোগ করেন আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা প্রতিটি মুহূর্ত।যারা সাম্প্রতিক সময়ে মেসিকে আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেখেছেন তাদের এই নতুন মেসিকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।

স্ক্যালোনি দিবালাদের এখনো সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন জাতীয় দলে নিজেদের প্রমাণ করার।সাথে আলেহান্দ্রো গারনাচোর মতন একেবারে বাচ্চাদেরও দলে রেখেছেন। স্ক্যালোনির ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নেই।আর জুলিয়ান আল্ভারেজ,অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারদের দলের সাথে রাখছেন-খেলাচ্ছেন-তৈরি করছেন।

আমার নিজেকে এখন কোনো ক্লাব বা দেশের সমর্থকের চেয়ে একজন ফুটবল সমর্থক হিশেবে পরিচয় দিতে ভাল লাগে।হয়তোবা ফুটবল নিয়ে অতিরিক্ত পড়াশোনা আর লেখালেখির একটা অবদান আছে এখানে।এই কথা বলার নিশ্চিত কোনো কারণ আছে।একজন নিরপেক্ষ দর্শক হিশেবে বিবেচনা করলেও স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভবনা বেশ প্রবল।আর একজন সমর্থক হিশেবে তো সবকিছুর বদলেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ চাই।

স্ক্যালোনির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে কী করে সেটির জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আরো পাঁচ মাস। বেশ দীর্ঘ সময় বলেই মনে হচ্ছে।ভালোবাসার অপেক্ষা মনে হয় দীর্ঘই হয়। দায়িত্ব পাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্ক্যালোনি যা করেছেন আর্জেন্টিনার জন্যে তার জন্যে তিনি অনেক প্রশংসার দাবিদার। স্ক্যালোনিকে আমি প্রথমদিকে পছন্দ করতাম না,এখন আবার অনেক ভালবাসি। ব্যাপারটা একেবারে সাদামাটা বাংলা সিনেমার মতন হয়ে পড়ল। নায়িকার নায়ককে প্রথমে ঘৃণা,পরে ভালবাসা। আর্জেন্টিনা-স্ক্যালোনির জন্যে না হয়ে ছেলে হয়েও নায়িকা হলাম, ক্ষতি কি!

ভালোবাসার জন্যে মানুষ কত কিছুই না করে!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link