বলা হয়ে থাকে, জগতের কোন কিছু নাকি নিঁখুত হয় না। কথাটা আসলেই সত্যি, সত্যি ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্যও। ফুটবল যাদের কাছে ধর্মের পর আরেকটা ধর্ম সেই তারকাময় ব্রাজিল দলেও আছে দুর্বলতা, আছে ঘাটতির জায়গা।
গোলপোস্ট থেকে শুরু করে আক্রমন ভাগ – ব্রাজিলের কোন পজিশনে সময়ের সেরা খেলোয়াড়রা নেই? প্রায় প্রতিটা পজিশনেই তারকার ছড়াছড়ি। অ্যালিসন, এডারসন, থিয়াগো সিলভা, মার্কুইনহোস, এডার মিলিটাও, ক্যাসমিরো, ফ্যাবিনহো, লুকাস পাকুয়েতা, নেইমার জুনিয়র, রাফিনহা, অ্যান্থনি, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, রোদ্রিগো এর মত সব বড় বড় নাম ব্রাজিলের স্কোয়াডে।
কিন্তু এত সব নামী দামি ফুটবলারদের মধ্যে একটা জিনিস অনুপস্থিত। খেয়াল করলেই দেখা যায় এরা কেউই ফুলব্যাক নয়। আর ব্রাজিলের স্কোয়াডে এটিই একমাত্র দুর্বলতা। সেটি হচ্ছে ফুলব্যাক, আধুনিক ফুটবলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পজিশনে বড্ড পিছিয়ে লাতিন আমেরিকার জায়ান্টরা।
ব্রাজিলের কোচ তিতে নিয়মিত দল সাজান ৪-৩-৩ ছকে। ফোর ম্যান ব্যাকলাইনে তাই দুইজন সেন্টার ব্যাকের সাথে দুইজন ফুলব্যাককে একাদশে রাখতে হয়। আর এই জায়গাতেই প্রতিটি ম্যাচে ফুটে উঠে সেলেসাওদের ঘাটতি। মাঠের দুই প্রান্ত দিয়ে বারবার প্রতিপক্ষ আক্রমণ শানায় ব্রাজিলের অর্ধে।
বর্তমানে ব্রাজিলের স্কোয়াডে যেসব প্লেয়ার ডিফেন্স লাইনের দুই পাশে লেফটব্যাক এবং রাইটব্যাক হিসেবে কোচের পরিকল্পনায় রয়েছেন তারা হলেন অ্যালেক্স সান্দ্রো, দানিলো, দানি আলভেস, এমারসন রয়্যাল এবং অ্যারানা।
এদের মধ্যে দানিলো এবং অ্যালেক্স সান্দ্রো ব্রাজিল কোচ তিতের প্রথম পছন্দের দুই ফুলব্যাক। কিন্তু তেতো হলেও সত্য যে, বর্তমান গতিশীল ফুটবলে অনেকটাই বেমানান এই দুইজন। ব্রাজিল যখন বল পায়ে আক্রমণে উঠে আসে তখন এই দুইজন বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই উইঙ্গাররা হয়ে পড়েন একাকি যোদ্ধা; ফলে তাদের জন্য ওয়ান টু ওয়ান পাস খেলে ডি-বক্সে ঢুকে পড়া অথবা ভাল ক্রস করা কঠিন হয়ে যায়।
শুধু আক্রমণের ক্ষেত্রেই নয়, রক্ষণভাগেও দানিলো, সান্দ্রোদের দুর্বলতা চোখে পড়ার মত। গত কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিলেন অ্যালেক্স সান্দ্রো। তাঁর ভুলেই সেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া।
আবার এমারসন রয়্যাল কিংবা দানি আলভেসকেও কখনো কখনো সুযোগ দেন সেলেসাও কোচ। তবে এমারসন এখনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনভিজ্ঞ। আর আলভেস তো ইতোমধ্যে ক্লাব ফুটবল থেকে এক রকমের নির্বাসনে আছেন। এই যুগের গতিময় উইঙ্গারদের সাথে পাল্লা দেয়া এই কিংবদন্তির জন্য প্রায় অসম্ভব বটে।
এছাড়া লেফটব্যাক হিসেবে অ্যারানা কার্যকরী একটি অপশন। অ্যারানার সঙ্গে লেফট উইংয়ে নেইমার, ভিনিসিয়াসের কম্বিনেশন বেশ ভালোভাবে জমে। কিন্তু বড় মঞ্চে, বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এই তরুণের উপর কতটা ভরসা করা যায় – সেটি একটা বড় প্রশ্ন।
বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত ফুটবলে একটা মানসম্মত ফুলব্যাক জুটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ফলাফল নিজেদের করে নিতে পারে। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে দলকে রক্ষা করার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব থাকে উইঙ্গারদের সাহায্য করা। বিশেষ করে ক্রসিং, ওভারল্যাপিং এর মত কাজগুলোতে দক্ষ ফুলব্যাক যেকোনো দলের বাড়তি শক্তি।
কখনো কখনো ডিফেন্ডিং এর চেয়ে ফুলব্যাকদের আক্রমণাত্মক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা সাজান কোচেরা। এক্ষেত্রে ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আর্নল্ড কিংবা আশরাফ হাকিমির কথা বলা যায়। তাঁরা প্রায় প্রতিটি ম্যাচে একজন এক্সট্রা উইঙ্গারের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ব্রাজিলের দলে ফুলব্যাকরা এমন কিছু করতে পারছেন কই।
কয়েক বছর আগেও মার্সেলো আর দানি আলভেসের দুর্দান্ত ফুলব্যাক জুটি যেকোনো দলের জন্য ভয়ের কারন ছিল। এর আগে রবার্তো কার্লোস, কাফু একসাথে মিলে সামলেছিলেন ব্রাজিলের ফুলব্যাকের দায়িত্ব।
অথচ যে ব্রাজিল থেকে এমন কিংবদন্তিদের জন্ম হয়েছে, সেই ব্রাজিলেই এখন ফুলব্যাক সংকট। সামনে কাতার বিশ্বকাপ, বিশ্বের সব ব্রাজিল ভক্তদের চোখ এখন হেক্সা জয়ের দিকে। কিন্তু ইউরোপের কোন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এই নড়বড়ে ফুলব্যাক পজিশনটা ব্রাজিলকে নিশ্চিতভাবেই ভোগাবে। এই অল্প সময়ে তিতে কি আদৌ এই সমস্যা সমাধান করতে পারবেন।
অবশ্য তিনি চাইলে বিকল্প কিছু ভাবতে পারেন। ফোর ম্যান ব্যাকলাইনের পরিবর্তে তিনজন সেন্টার ব্যাক খেলাতে পারলে ফুলব্যাক নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা কমবে। আবার সিলভা, মার্কুইনহোস আর মিলিটাও থাকায় ডিফেন্স নিয়েও নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। এদের মত পরীক্ষিত সেন্টার ব্যাকের উপর এতটুকু ভরসা তো করা-ই যায়।