ভারতের গত উনচল্লিশ বছরের মধ্যে ওয়ান ডে ক্রিকেটের সেরা জয় বাছতে বললে দশজনের মধ্যে আটজনই ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের কথা বলবেন।
এই বিশ্বকাপ জয়ের কান্ডারী কারা ছিলেন? ফাইনাল ম্যাচে যদি ফিরে যাই, অবশ্যই ধোনি, গম্ভীর এবং শুরুতে জাহির খানের একটা স্বপ্নের স্পেল যা শ্রীলঙ্কার টস জেতার যাবতীয় সুবিধে শুষে নিয়ে আরব সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কিন্তু শুধুই কি তাই? আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা, ভারতের প্রথম নক আউট ম্যাচ, আহমেদাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শুরু হবার আগে যখন ভারতীয় দল হোটেল ছেড়ে বেরোচ্ছে, তার ঠিক আগে ছজন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এঁরা ছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা ছজন খেলোয়াড়। তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন, যে সেদিন কি কি ভুল হয়েছিল, তারা অতিরিক্ত উত্তেজনায় ফুটছিলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চেষ্টা করছিলেন এবং স্নায়ুর চাপ ধরে রাখতে পারেননি। ভারত সেই ভুলগুলো ২০১১ সালে আর করেনি। এই ছজন কে কে ছিলেন? সেটা এই পোস্টের আলোচ্য বিষয় নয়। পাঠক ভেবে বের করতে পারেন।
গৌতম গম্ভীর বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় দুটো ট্রফি জয়ের ফাইনালে রান করেছেন। কিন্তু দুটি ইনিংস মনে পড়ছে, যেখানে কিছুটা দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে রান আউট হয়ে তিনি নিজেকে ভালো ব্যাটসম্যান থেকে গ্রেট এ উন্নীত করার সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন।
প্রথমত ২০০৯ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তান ম্যাচ। ৩০২ তাড়া করে দ্রুত শচীনকে হারিয়েও গম্ভীর আর দ্রাবিড় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতকে। এমন সময় দ্রাবিড়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন গম্ভীর। ফিল্ডার ছিলেন ইউনিস খান যিনি সরাসরি ছুঁড়ে উইকেট ভেঙে দেন। না, গম্ভীর ডাইভ মারেননি। নিজেকে অভিসম্পাত দেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিলনা তাঁর। ভারত একটা দুর্দান্ত জয়ের কক্ষপথ থেকে ভেঙ্গে পড়ে বড়ো ব্যবধানে হেরে যায়।
দ্বিতীয় উদাহরণটি খুবই সাম্প্রতিক। অস্ট্রেলিয়ার সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে বেশ ভালো খেলতে খেলতে হঠাৎই ৪০ রান পেরোনোর পরে গম্ভীর অদ্ভুত খারাপ রানিং বিটুইন দা উইকেট শুরু করেন। দুবার তিনি বা যুবরাজ যে কেউ রান আউট হতে পারতেন কিন্তু বেঁচে যান। তারপরে তৃতীয়বার যুবরাজের কল না থাকা সত্ত্বেও দৌড়ে নিজেকে রানআউট করেন। যদিও এই ম্যাচটি যুবরাজ দুরন্তভাবে চাপ সামলে ভারতকে জয় এনে দেন, নইলে গম্ভীরের হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় থাকতো না।
এটা অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে গম্ভীর ৪০ ও ৯০ এর ঘরে একটু ছটফট বেশি করতেন। তিনি চাইতেন দ্রুত ৫০ বা ১০০ পূর্ন করে ফেলতে। ফাইনালেও তিনি ৪৭ রানের মাথায় পয়েন্টের প্রায় হাতে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান বলটি সামান্য আগে ড্রপ খাওয়ায়। পরের বলটি তিনি পয়েন্টের পাশ দিয়ে জোরালো শট মেরে দু রানের জন্যে কল করে ছোটেন।
দ্বিতীয় রান যখন মাঝামাঝি সম্পূর্ন হয়েছে, তখন গম্ভীর উপলব্ধি করেন যে তিনি হয়তো সময়ে ক্রিজে পৌঁছতে পারবেন না। এরপরে যা ঘটলো, সেটা গম্ভীরের ফাইনালের ৯৭ রানের ইনিংসের একটা মহাগুরুত্বপূর্ন মুহূর্ত। ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়েরও বটে। গম্ভীর যথাসম্ভব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ মারলেন, যাকে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ফুল লেংথ ডাইভ বলে। ক্রিজে ঢোকার মুহূর্তে তাঁর কোমর ও পা শূন্যে উঠে একটি উল্টানো C অক্ষরের রূপ ধারণ করে।
দুই কণুই পিচে ঘষটে যায় এবং মাথা জমির সামান্য উপরে থাকে। এই ছবিটি পরবর্তীতে গম্ভীরের কেরিয়ারের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থেকে যাবে। এই ঝাঁপ দেবার পরে যে মাটি গম্ভীরের জার্সিতে লেগে যায়, সেই মাটিমাখা জার্সি গম্ভীর সযত্নে রেখে দিয়েছেন নিজের বাড়িতে কাঁচের শোকেসে।
গম্ভীর রান আউট হননি। তাঁর এই জীবন বাজি রেখে মারা ডাইভ একচুলের জন্যে তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়। তিনি ধোনির সাথে লম্বা পার্টনারশিপ করে ভারতকে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে যান। যদিও ৯০ এর ঘরে আবারও ছটফটানি তাকে বিশ্বকাপ ফাইনালের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু মনে হয়না ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের থেকে সেটাকে গম্ভীর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
২০১৯ সালে সেমিফাইনালে ধোনি ডাইভ দেননি। দুদিন আগে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হরমনপ্রীতও আরেকটু দ্রুত দৌড়াননি।
ভারত সেই দুটো সেমিফাইনাল জেতেনি। যদিও এই দুটি রানআউট ভারতের ম্যাচ হারার একমাত্র কারণ নয়, তবে দুটি সেমিফাইনালের ‘কি মোমেন্ট’ তো বটেই। অনেক ভুল, খারাপ খেলার পরেও যখন মনে হচ্ছে ম্যাচটা জেতা যাবে, তখনই এই দুটি রানআউট ভারতকে ম্যাচ থেকে বের করে দেয়।
গৌতম কিন্তু বুদ্ধ হতে পেরেছিলেন, মোক্ষলাভ হয়েছিল তাঁর।