ডব্লিউ জি গ্রেস আর লেন হাটন ১ ঘন্টা ব্যাটিং করে গড়ে রান করতেন ৩৬। সিবি ফ্রাই আর এফ.এস জ্যাকসন ঘন্টাপ্রতি তুলতেন ৪০ রান। জ্যাক হবস, ক্লেম হিল আর ওয়ালি হ্যামন্ড তুলতেন ৪৩ রান। কম্পটন আর ব্র্যাডম্যান তুলতেন ৪৭ রান করে, ম্যাকাবে আর রণজি তুলতেন ঘন্টাপ্রতি গড়ে ৫০ রান। দিলীপসিংজি ঘণ্টায় তুলতে পারতেন গড়ে ৫২ রান। ভিক্টর ট্রাম্পার পারতেন ঘন্টায় গড়ে ৫৫ রান তুলতে।
আর গিলবার্ট জেসপ? ক্যারিয়ারে যে ১৭৯ বার পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংস খেলেছেন, সেগুলোতে ঘণ্টায় ৭৯ করে রান তুলেছেন জেসপ! সেঞ্চুরি পেরোনো ইনিংসগুলোতে তো আরও বিধ্বংসী ছিলেন জেসপ। যেই ৫৩ বার সেঞ্চুরি করেছেন তিনি, সেগুলোতে ঘন্টাপ্রতি রান তুলেছেন প্রায় ৮৩ করে(৮২.৭)!
জেসপের সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর মন্তব্যটা করেছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি রিচি বেনো। বেনো বলেছিলেন, ‘জেসপই সম্ভবত সবচেয়ে সেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার, যে কোনোদিন ওয়ানডেই খেলেনি।’
হ্যা। জেসপ কোনদিনই ওয়ানডে খেলেননি। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের ক্রিকেটার ওয়ানডে ক্রিকেট খেলবেনই বা কী করে? ওয়ানডে ক্রিকেটের বয়সই তো কেবল বছর পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে শুরু হওয়ার ১৬ বছর আগেই ওপারে পাড়ি দিয়েছেন জেসপ।
যাই হোক, জেসপ ৫০ ওভারের ক্রিকেট না খেললেও তার প্রতিফলন রেখে গেছেন তার ক্যারিয়ার জুড়ে। আজকের গেইল, ডি ভিলিয়ার্সরা যদি ভিভ রিচার্ডস, গ্যারি সোবার্সদের উত্তরসূরি হয় তাহলে ভিভ, সোবার্সদের পূর্বসূরি ছিলেন এই গিলবার্ট জেসপ। বলা যেতে পারে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি।
১৮৯৪ থেকে ১৯১৪- ক্যারিয়ারজুড়ে প্রায় ২৬ হাজারের মত রান করেছেন জেসপ। তবে নিশ্চিতভাবেই তাঁর রানসংখ্যা আরো বাড়তে পারতো, পারেনি তখনকার ক্রিকেটের অদ্ভুত নিয়মের কারণে। তখন ছয় হতে হলে শুধু বাউন্ডারি পার করলেই হতো না, বল ফেলতে হতো স্টেডিয়ামের বাইরে! বল যদি উড়ে গিয়ে গ্যালারিতেও পড়ে, তাহলেও সেটিকে ছয় না দিয়ে চার হিসেবে ধরা হত।
ক্যারিয়ারে মোট ৫৩ বার সেঞ্চুরি করেছেন জেসপ (৫ বার ডাবল সেঞ্চুরিও করেছেন), তিনি যখন অবসর নেন তখন মাত্র ১৩ জন ব্যাটসম্যানের তাঁর চেয়ে বেশি সংখ্যক সেঞ্চুরি ছিল। চার বার একই ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরির নজির ছিল জেসপের, কেবল সিবি ফ্রাইয়েরই ৫ বার এই রেকর্ড ছিল। তাঁর সেঞ্চুরি ছাড়ানো ইনিংসগুলোর গড় স্কোর ছিল ১৪০, যা সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের সাথে পাল্লা দেয়ার যোগ্য। ডব্লিউ জি গ্রেসের সেঞ্চুরি ছাড়ানো ইনিংসগুলোর গড় স্কোর ছিল ১৪৬, ভিভ রিচার্ডসের ১৪৪, জিওফ বয়কটের ১৪০ আর স্যার জ্যাক হবসের ১৩৪।
এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জেসপ সেঞ্চুরি করেছেন মোট ১২ টি। জেসপের ক্যারিয়ারের দ্রুততম সেঞ্চুরি ছিল মাত্র ৪০ মিনিটে, ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে। ১৯০৭ সালের এক ম্যাচে ৪২ মিনিটে সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত মাত্র ৯০ মিনিটে ১৯১ করে মাঠ ছেড়েছিলেন সেদিন! দ্রততম সময়ের মধ্যে সেঞ্চুরি করা জেসপের এই রেকর্ড টিকে ছিল বহুদিন। ১৯২০ সালে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে সারের হয়ে মাত্র ৩৫ মিনিটে সেঞ্চুরি করে জেসপের ১৩ বছর ধরে অক্ষত থাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেঞ্চুরির সে রেকর্ডটি ভেঙ্গে দেন পার্সি ফেন্ডার।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটি অবশ্য এখনো জেসপের দখলেই। ২৮৬ রানের ইনিংসটি খেলার পথে মাত্র দুই ঘণ্টায় ২০০ করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরিটিও জেসপেরই, ১৯০৫ সালে সমারসেটের বিপক্ষে ২৩৪ রানের ইনিংস খেলার পথে ১৩০ মিনিটে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন জেসপ। ১৯০১ সালে লর্ডসে ২৩৩ রানের ইনিংস খেলার পথে ১৩৫ মিনিটে ২০০ করেছিলেন তিনি!
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জেসপ বেশ সফল হলেও টেস্ট ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার সেই রেশ দেখা গেছে মাত্র একদিনই। দিনটি ছিল ১৯০২ সালের ১৩ আগস্ট। ওভালের উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে ২৬৩ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। কিন্তু ১০ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে তারা, জেসপ যখন নামছেন তখন ইংল্যান্ডের স্কোর ৫ উইকেটে ৪৮! অস্ট্রেলিয়ার জয়ই তখন মনে হচ্ছিল একমাত্র সম্ভাব্য ফল, কিন্তু জেসপ সব ওলট পালট করে দিলেন।
ওই খারাপ উইকেটেই মাত্র ৭৭ মিনিটে ১৩৯ বলে ১০৪ রানের ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডকে জিতিয়ে দিলেন ১ উইকেটে! অবশ্য সেদিনের ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরিটিই হয়ে যায় জেসপের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম এবং শেষ সেঞ্চুরি। এর পরে আর কোনো টেস্টেই ব্যক্তিগত ইনিংসকে তিন অঙ্কে নিয়ে যেতে পারেননি জেসপ।
সময় অতীতকে টেনে আনে, সেই সাথে মাঝেমধ্যে বহু যুগ যুগান্তর পিছন ফিরে তাকাতে হয় কিংবদন্তীদের কীর্তিগাঁথাগুলোকে অনুভব করার জন্য। আজ ১৯ মে। ১৮৭৪ সালের এই দিনে গ্লস্টারশায়ারের চেল্টেনহামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান গিলবার্ট জেসপ।